ভরতনাট্যমের ছাত্রী কীভাবে হয়ে উঠলেন ক্রিকেট মাঠের ডাকাবুকো ক্যাপ্টেন!

ক্রিকেট লিঙ্গ-নির্ভর খেলা নয়।  ছেলেদের ক্রিকেট আর মেয়েদের ক্রিকেট আলাদা- এমন কোন ব্যাপার নেই। 

খেলার মাঠ, ক্রিকেটের ব্যাট-বল, গ্যালারির দর্শক, ম্যাচ জয়ের ট্রফি কিংবা ম্যাচ হারার চোখের জল শুধু ছেলেদের। মেয়েরা দূরের দর্শক- এই ধারণাকে এক ঝটকায় বদলে দিয়েছিলেন  মিতালী রাজ আর তাঁর টিম ইন্ডিয়া। দেশবাসী আর গোটা ক্রিকেট বিশ্বকে বার্তা দিয়েছিলেন এবার বদল আসুক ভাবনায়। মেয়েরাও পারে মাঠে-ময়দানে রাজত্ব করতে।  মিতালী বলেছিলেন , আমরা ফাস্ট  বল খেলতে পারি না। আমরা ফাস্ট বল করতে পারিনা। এমন অনেক ভুল ধারণা আছে। আমাদের মিক্সড ম্যাচ হওয়া উচিত। ছেলেদের বিরুদ্ধে অনেক ম্যাচ আমি খেলেছি। সেভাবেই আমার ট্রেনিং হয়েছে।

এমন কথা তাঁকেই মানায়। ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অধিনায়ক, বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটার। রাজস্থানের যোধপুরে জন্ম তাঁর, বেড়ে ওঠা সেকেন্দ্রাবাদে। ভারতীয় বাবা-মারা চান তাঁদের সন্তান ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হোক। নিদেন পক্ষে প্রফেসর। মেয়ে হলে চাই, দৌড়ঝাঁপ নেই- এমন নিরাপদ কোনও পেশা। সেই জায়গায় মিতালী হলেন ক্রিকেট মাঠের ডাকাবুকো ক্যাপটেন। কীভাবে সম্ভব হল?

বাবা দোরাই রাজ এয়ার ফোর্সের অফিসার ছিলেন। তাই মিলিটারি ডিসিপ্লিন চলত বাড়ির অন্দরে। ব্যতিক্রম ছিল বাড়ির ছোট মেয়েটি। কিছুতেই সকালে ঘুম ভাঙত না তার। মা ডাকতেন ‘নিন্দ কি রানী’ বলে। সকালে ঘুম থেকে ওঠা অভ্যাস করাতে বাবা মিতালিকে মাঠে নিয়ে যেতে শুরু করলেন। কাঁটায় কাঁটায় রোজ সকাল ৬ টা। সেভাবেই প্রথম পরিচয় মাঠ আর খেলার সঙ্গে।

আরও একটি গল্প আছে তাঁর। জীবন ক্রিকেটময় হয়ে ওঠার নেপথ্যে তাঁর দাদার ভূমিকা কিছু কম নয়। মিতালী হতে চাইতেন তাঁর দাদার মতো।

দাদা ক্রিকেট খেলত। দাদা যা করবে বোনও তাই করবে। তাই দাদার বাজি হয়ে উঠল বোনেরও বাজি। ক্রিকেট কোচিং সেন্টারে বাধ্য ছাত্রী হয়ে উঠল বোন।

৯০ দশকে মেয়েদের ক্রিকেট- ভাবনাটা মোটেই সহজ ছিল না। তাঁর বাবা-মাকেও বার বার পড়তে হত প্রশ্নের মুখে।

“ক্রিকেটে কী আছে?এটা তো ছেলেদের খেলা তাহলে মেয়েকে কেন ক্রিকেটে?”

সব সমালোচনাকে থামাতে মিতালির বাবা উত্তর দিয়েছিলেন- দেশের জার্সি সন্তানের গায়ে উঠুক। এটাই তাঁর একমাত্র স্বপ্ন”।

বাবার স্বপ্ন আর নিজের প্যাশন এক হয়ে যায় মিতালীর জীবনে। আট বছর বয়সে ভরত নাট্যম শিখতেন। ১০ বছর বয়স থেকে সঙ্গী হয় ক্রিকেট।   

১৯৯৯ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রবেশ মিতালির। মাত্র ১৬ বছরে ওয়ান ডে আন্তর্জাতিকে অভিষেক। আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে নিজের একদিনের ক্রিকেট কেরিয়ারের প্রথম ম্যাচটি খেলেছিলেন । শতরানও করেন সে বছরই।

শুধুমাত্র ভারতীয় ক্রিকেটই নয়, বিশ্ব মঞ্চেও মেয়েদের ক্রিকেটে আইকন মিতালি। মেয়েদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সর্বাধিক রান সংগ্রাহক।

মিতালীর নামের পাশে একাধিক রেকর্ড রয়েছে। বিশ্বের এক নম্বর ক্রিকেটার হয়ে ওঠা, সবচেয়ে বেশি দিন ভারতকে এক দিনের ক্রিকেট এবং টি-টোয়েন্টিতে নেতৃত্ব দেওয়া এরকম আরও অগুন্তি।

২০১৭ মহিলা বিশ্বকাপে, ওয়ানডে ক্রিকেটার তালিকায় সকল মহিলাদের মধ্যে মিতালীর নাম ছিল এক নম্বরে। কেরিয়ারে  ১০ হাজার রান সম্পূর্ণ করছেন। ২০১৭ সালে, তাঁর অধিনায়কত্বে ভারতীয় দল মহিলা ক্রিকেট আবার বিশ্বকাপের ফাইনালে পৌঁছায় এবং ইংল্যান্ডের কাছে নয় রানে হার শিকার করতে হয়।

সেই বছরেই  ডিসেম্বর তিনি আইসিসি মহিলা বর্ষসেরা ক্রিকেটার হন। পুরুষ ও মহিলা ক্রিকেট মিলিয়ে তিনি ভারতের একমাত্র অধিনায়ক যাঁর নেতৃত্বে দুটি ওয়ান ডে বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলেছে ভারত। দুরন্ত কেরিয়ারে মিলেছে পদ্মশ্রী, অর্জুন পুরস্কার ও ধ্যানচাঁদ খেলরত্ন।

২০২২ এর জুনে ক্রিকেটকে বিদায় জানান মিতালি। এখন তাঁকে ধারা ভাষ্যকারের ভূমিকায় দেখা যায়। ২০২২-এ মুক্তি পায় মিতালীর বায়োপিক ‘সাবাস মিঠু’। পরিচালনায় সৃজিত মুখোপাধ্যায়। মিতালীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন অভিনেত্রী তাপসী পান্নু 

ক্রিকেট ছাড়া জীবনে অন্য কোনও খেলা তাঁকে কখনও টানেনি। সব ফোকাস আর এনার্জি ক্রিকেট ঘিরেই ছিল। তবে এখন ভাল লাগে পিকল বল।

কে বলতে পারে আরও ১০ বছর পরে হয়ত এই খেলাতেও ভারতকে নেতৃত্ব দেবেন হয়ত মিতালী রাজ।

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...