শুভ জন্মদিন দত্ত সাহেব!

তিনি বলেন গানই তাঁর পরিচয়। অভিনেতা নন। পরিচালক নন। নাট্যকার নন। তিনি শুধু গায়ক। গান লেখেন। সুর করেন। গান গান। সবটাই ভালোবেসে। বাঙালির দত্ত বাবু। অঞ্জন দত্ত।

অঞ্জন মানেই বাঙালির কাছে পাগলকরা পাহাড়ি হাওয়া। সে হাওয়ায় ক্ষ্যাপামি আছে দুরন্ত, আর আছে ভেসে যাওয়ার টান। সেই টানেই ভেসে গিয়েছিল নব্বই দশকের কলকাতা।

কালো শার্ট, নীল জিনস,  কালো সানগ্লাস। সঙ্গে গিটার। মঞ্চে এলেই ঘুম শহর জেগে ওঠে গানে গানে। ঘুরে বেড়ায় আড়ায়-পাড়ায়। বো-ব্যারাকের অ্যাংলোপাড়ারগন্ধ মেখে মধ্যবিত্ত ভিতু প্রেমের অসহায়তায়। সেখানে বেকারত্বের যন্ত্রণা আছে। প্রেমিকা আজ অন্য কারুর হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা আছে আবার সে গান যুদ্ধহীন রঙিন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখায়।

অঞ্জন সিনেমায় আছেন। মঞ্চে আছেন। বাঙালির বেঁচে থাকায় আছেন। এই শহরের সময় স্মারক হয়ে। নব্বইয়ের আবেগে গানের জানলা হয়ে।

‘এটা কি 2441139 ‘ বেলা বোসের বাড়ির টেলিফোনখানা বেজে চলে আজও। বেলার প্রেমিক ফোন করে চলে। চাকরি পেয়ে গেছে সে, এখন আর কেউ তাদের আটকাতে পারবে না। বাংলা গানের শ্রোতারা ঘুরিয়েফিরিয়ে শুনে যায় অঞ্জন। আর অঞ্জন ছুটে যান গিটার থেকে কলম হয়ে পর্দায়।

অঞ্জন দত্তের প্রথম ছবি ১৯৮১তে মৃণাল সেনের পরিচালনায় ‘চালচিত্র’। তাঁর নিজের কথায় এই ছবি তাঁর নিজের কাছেই কখনই অভিনয়ের দিক থেকে প্রথম কাজ বলে মনে হয়নি। এতটাই সাবলীলভাবে কাজ করেছিলেন। তার মূল অনুঘটক ছিল পরিবেশ।

ভেবেছিলেন ‘নায়ক’ হবেন, সে সব বদলে দেন মৃণাল সেন। একুশ বছর বয়সের অঞ্জনকে বদলে দিয়েছিলেন তিনি। নতুন চারা জল পেয়েছিল তাঁর হাতে। মৃণাল সেন তাই তাঁর কাছে তাঁর নিজের শিক্ষক, বন্ধু, পরিচালক, সহকর্মী, বাবার মতো অনেক কিছুই। কান চলচ্চিত্র উৎসবে যখন ‘চালচিত্র’ ডাক পেল তখন বলেছিলেন ‘ওখানে আমাকে মৃণাল বলবি। মৃণালদা একদম নয়!’  

‘চালচিত্র’-এ অভিনয়ের জন্য সেরা নবাগত অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছিলেন ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে। তারও পরে আরও অনেকবার কাজ করেছিলেন মৃণাল সেনের সঙ্গে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি মেতেছেন যুক্তি-তক্কোর মেধাচর্চায়। সিনেমা থেকে রাজনীতি সব মিশেছে সেখানে। আর মিশেছে কলকাতা।

কলকাতা গান হয়ে উঠেছে অঞ্জনের কাছে। সেই কলকাতা আন্তর্জাতিক কলকাতা। কেরালা থেকে কোয়েম্বাটোর, জাপান মিশে গিয়েছে গানের জানলায়। কিন্তু নিজে চেয়েছিলেন পুরোদস্তুর অভিনেতা হতে। তাঁর আফসোস বড় মাপের পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন বড় অভিনেতা হতে পারেননি। তাঁর কথায়, ‘’যদি বয়স কম হত, তাহলে অভিনেতাই হতে চাইতাম’।

১৯৮২ সালে ‘গৃহযুদ্ধ’ সিনেমায় অভিনয়ের পর সিনেমা ফেলে তিনি চলে গিয়েছিলেন জার্মানিতে শুধু থিয়েটারের টানে। ওখানে ছিলেন পাক্কা তিন বছর। জার্মানিতে অঞ্জন থিয়েটার দেখেছেন, করেছেন এবং শিখেছেনও। থিয়েটারের মাধ্যমেই সিনেমায় কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন অঞ্জন।

নিজের জীবনের গল্প নিয়ে লিখেছেন আত্মজীবনী ‘অঞ্জনযাত্রা’, ২০১৮তে বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হয় সেই বই। কলকাতার অঞ্জনের ‘অটোবায়োগ্রাফি’ ধাকায় কেন এ নিয়ে কম চমক জাগেনি। নিজের জীবনের গল্প বলতেও অকপট অঞ্জন। শিল্পীর কাজের বাইরে একজন মানুষ থাকে। তাঁকে মানুষ খুব একটা চেনে না। কাজের বাইরের সেই মানুষটাই উঠে এসেছে বইয়ের পাতায়। তাঁর কাছে ‘অঞ্জনের জীবনী’ মানে আলো-অন্ধকারে থাকা একজন সম্পূর্ণ মানুষ। নিজেকে এভাবে আত্মজীবনীতে উজাড় করা তাঁর জন্য খুব সহজ ছিল না। প্রথম দিকে নিজের সঙ্গে যুদ্ধও করতে হয়েছে।

আত্মজীবনী ‘অঞ্জনযাত্রা’ প্রকাশিত হওয়ার পর অঞ্জন-ভক্তদের মনে প্রশ্ন এসেছিল তাহলে কী ‘অঞ্জন দত্ত’র বয়স বাড়ছে? সেই ভাবনাকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে অঞ্জন দত্তর চেনা ভঙ্গিতে মন্তব্য ‘আমি এখনও ১৫’!

এবারের বড়দিনে মুক্তি পেয়েছে নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নতুন ছবি ‘হামি ২’। সেই ছবিতে অঞ্জন ‘নিতাই জ্যাঠা’। ছবির নিতাই জ্যাঠাবাংলা ইশকুলের মাস্টারমশাই আর লাইব্রেরি চালায়। গায়ে খদ্দরের পাঞ্জাবি, ধুতি আর কালো ফ্রেমের চশমায় এ যেন নতুন অঞ্জন। দেখে কে বলবে এতগুলো বছর ধরে এই মানুষটাই বাঙালিকে সাহেবি কেতায় অ্যাংলো পাড়ার প্রেমে ফেলেছেন বারবার।

আজ ৭০ বসন্তে পা দিলেন অঞ্জন দত্ত। ১৯৫৩-র ১৯ জানুয়ারি এই কলকাতা শহরেই তাঁর জন্ম হয়। নিজেকে নিয়ে চালিয়েই যাচ্ছেন ভাংচুর। মেরি অ্যানের প্রেমিক এখন ‘রিভলবার রহস্য’-এ মেতেছেন।   

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...