পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকের গোড়ার দিকে সপ্তগ্রামের মূল নদী ছিল সরস্বতী নদী। এই নদীকে কেন্দ্র করেই সপ্তগ্রাম বাংলার অন্যতম বাণিজ্যের পীঠস্থান হয়ে ওঠে। শ্রেষ্ঠীরা মুঘল সম্রাটদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য চালাতেন সেখানে। ভারতের নানা উপকূলে ছড়িয়ে পড়েছিল তাদের বাণিজ্যতরী। সপ্তগ্রামের শ্রেষ্ঠীরা অনেকেই ছিলেন তন্তুবণিক। শ্রেষ্ঠী শব্দটির অপভ্রংশ হয়ে পরবর্তীকালে শেঠী ও শেঠ শব্দদুটির জন্ম হয়। সপ্তগ্রামের শেঠ-বসাক এতটাই প্রতিষ্ঠাবান ছিলেন যে ব্রিটিশ পূর্ব ভারতের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তাঁরা ইতিহাসের বুকে একটা অন্যতম স্থান গড়ে নিয়েছে। ১৫২০-১৫৩০, এই সময় নাগাদ সরস্বতী নদী পলি মাটিতে বুজে যেতে থাকে। তখন সপ্তগ্রামে ব্যবসা চালানো দুষ্কর হয়ে ওঠে। ছোট ছোট নৌকো ছাড়া সমুদ্রগামী বড় নৌকো ও সপ্তগ্রাম বন্দরে ঢুকতেই পারত না।। তখন শেঠরা ধীরে ধীরে সপ্তগ্রাম থেকে কলকাতায় চলে আসেন। তাঁরা কখনোই তাঁদের ব্যবসা-বাণিজ্য ত্যাগ করেননি। বর্তমানের ব্যাঁটরায় এসে পর্তুগিজদের সঙ্গে বাণিজ্য শুরু করেন। এদিকে সেখান থেকেও কলকাতায় প্রতিদিন ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজ সামলানো কঠিন হয়ে পড়ছিল।
১৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে শেঠ বাড়ির আদি পূর্বপুরুষ মুকুন্দরাম শেঠ কলকাতার কালীঘাটে এসে প্রথম বসতি স্থাপন করেন। প্রথমে ছিল গঙ্গাজলের ব্যবসা। নিজেদের নামের সিলমোহর দেওয়া গঙ্গাজল ভারতের নানা জায়গায় রপ্তানি করতেন তিনি। বহু মানুষের কাছে গঙ্গাজল বিক্রি করে তাদের আর্থিক অবস্থা ফুলে ফেঁপে উঠেছিল। তার অন্যতম বংশধর যাদবেন্দ্র শেঠ বাঁশতলা স্ট্রিটে যে রাধাকান্ত জিউ-এর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন আজ ও তার ভোগ গঙ্গা জল ছাড়া রান্না হয় না। ঠাকুরের ভাত, ডাল, তরকারি গঙ্গাজল দিয়েই রান্না করতে হয়।
এই বাঁশতলা স্ট্রিট এর বর্তমান নাম স্যার হরিরাম গোয়েংকা স্ট্রিট। বড় বাজারের সদা ব্যস্ত একটি পাড়া। এখানেই রয়েছে শেঠেদের আদি বাড়ি। মুকুন্দরাম শেঠ তার কূল দেবতা শ্রী শ্রী গোবিন্দ রায় জিউকে নিয়ে বর্তমান কালীঘাটের মন্দিরের উত্তর-পশ্চিমের আদি গঙ্গার সংযোগস্থলে প্রথম বসতি স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু জায়গাটি ছিল অস্বাস্থ্যকর। প্রতিবছর নোনা জলে জায়গাটি ভেসে যেত। তাই তিনি তার পরিবার নিয়ে বর্তমান লালদীঘি অর্থাৎ বিনয় বাদল দীনেশ বাগের কাছাকাছি একটি জায়গায় উঠে আসেন। তখন সেখানে জঙ্গল। এই জঙ্গল কেটে তারা প্রথম বসতি স্থাপন করেন। এই মুকুন্দরাম শেঠের ছেলে লালমোহন শেঠ ওখানে যে পুকুর খনন করেছিলেন সেই পুকুরেরই বর্তমান নাম আজ লালদিঘি।।
মূলত সুতো ও কাপড়ের ব্যবসা করতেন শেঠ পরিবার। পর্তুগিজ ইংরেজ ওলন্দাজ ফরাসি বণিকদের দ্বারা সেইসব কাপড় বিক্রি করতেন। শেঠ পরিবার মূলত দক্ষ বস্ত্র ব্যবসায়ী ছিলেন। সেসময় প্রতি শনিবার সুতানুটিতে হাট বসতো। হাটে বিদেশি বণিকরা এসে কাপড় কিনতেন। গিরিধারী তাদের সঙ্গে প্রায় একচেটিয়া কারবার গড়ে তুলেছিলেন। শুধু তৈরি ও কাপড় বোনার জন্য তিনি গোবিন্দপুরে একটি বড় কারখানাও তৈরি করেন। সেখানে রোজ আড়াই হাজার তন্তুবায় কাজ করতেন। এ সবটাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতে ব্যবসার অন্যতম ঘাঁটি গড়ে তোলার আগের কথা। তখন ম্যানচেস্টার থেকে কাপড় এসে দেশীয় শিল্পকে বিপন্ন করে তোলেনি।
সাহেবদের সঙ্গে ব্যবসার আগে কলকাতার সঙ্গে তার হিন্টারল্যান্ড বা পশ্চাদ্ভভূমির সম্পর্ক ছিল নিবিড়। আশপাশের অঞ্চল থেকে শিল্পীরা কলকাতার হাটে বিক্রি-বাটা করে লাভবান হতেন। কলকাতার মানুষদেরও সেই জিনিসপত্র পছন্দ হতো। ইংরেজরা আসার পরে এমন অর্থনৈতিক অবস্থা সৃষ্টি হয় যা পশ্চাৎভূমিকে সম্পদশূন্য করে কলকাতাকে বিত্তবতী করে তোলে। যদিও শেঠেদের ইংরেজদের সঙ্গে কখনোই সম্পর্ক ভালো ছিল না। কারণ তারা ছিলেন দাদণি বণিক। শেখ পরিবারের বৈষ্ণবচরণ ও শোভারাম বসাক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসা করে ব্যক্তিগতভাবে নিজেরা বিত্তশালী হয়েছিলেন।
১৫৫৭ খ্রিস্টাব্দে তখনকার গোবিন্দপুরে বর্তমান ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের জন্য জায়গা দরকার হয়। শেঠরা এই জমি ছেড়ে দিয়ে তাদের কুলদেবতাকে নিয়ে উঠে আসেন বড় বাজারে। এরপর শুরু হয়েছিল ম্যানচেস্টার থেকে পুরোদস্তুর মিলের কাপড় আমদানি করা। ব্যবসার ক্ষতি হয় তখন। চাকরি নিতে বাধ্য হন অনেকেই। লাট সাহেবের দেওয়ান থেকে শুরু করে আদালতের জজ, সাব জজ, মুন্সি এরকম নানা চাকরি তারা করেছেন ব্যবসা ছেড়ে। কাপড়ের ব্যবসার বদলে তিসির তেল এবং রঙের ব্যবসাতেও নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন অনেকেই।
বড় বাজারের শেঠ পরিবারের বংশধর ও আত্মীয় পরিজনদের অনেকেই এখন কলকাতার কাশীপুর, চিৎপুর, কোম্পানি বাগান এলাকায় বাড়ি করে থাকেন। পারিবারিক কাপড়ের ব্যবসার ধারা বজায় রেখেছেন অনেকেই। কেউ আবার চলে গেছেন অন্য কাজের ক্ষেত্রে।
স্যার হরিরাম গোয়েংকা স্ট্রিটের শেঠ বাড়িটির তিনটি মহল রয়েছে। তিনমহলে বাড়ির অন্দরমহল বাহিরমহল ও মাঝের মহল যথেষ্ট যত্ন পায়। বাড়ির গায়ে পড়েছে নতুন পলেস্তেরা। ফলে ঝরাজীর্ণ বা ম্লান চেহারা তার নয়। এখানে রাধাকান্ত জিউ ঠাকুরের দোল উৎসব মহাসমারোহে পালিত হয় প্রতিবছর। এক এক পরিবারের পালা পড়ে। এরা কলকাতার বনেদিয়ানা আধুনিক কায়দায় আজও বজায় রেখেছেন। কিন্তু শেঠেদের বাড়িতে নেই কোন নাচ ঘর। বাইজি নাচের আসর বসিয়ে সাহেবদের নেমন্তন্ন করে পার্টি দেওয়ার সংস্কৃতির সঙ্গে শেঠেরা কোনদিনই পা মেলাননি। তারা বরাবর নিজেদের ব্যবসা এবং পরিবার নিয়ে থেকেছেন।
স্যার হরিনাম গোয়েংকা স্ট্রীট এর একটা গলির পরেই শোভারাম বসাক স্ট্রীট। শোভারাম বসাকের বাড়ি এখানে। বসাকরা উপযোগী নানা ব্যবসায়ী লিপ্ত থেকেছেন। বর্তমানেও তারা ব্যবসায়ী করছেন। তবে সেটাও আধুনিক কায়দায়। কলকাতার বুকে এই শেঠ বাড়ি তার নিজের মতো করে ইতিহাসের উদাহরণ হয়ে টিকে রয়েছে।