জন্মাষ্টমী ও নন্দোৎসব থেকেই শুরু হয় দেবী দুর্গার পুজোর প্রস্তুতি

ভাদ্রের সবচেয়ে বড় উৎসব হল জন্মাষ্টমী। জন্মাষ্টমী উৎসব ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে পালন করা হয়। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, দ্বাপর যুগে দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনের জন্য শ্রীকৃষ্ণ এই দিনই জন্ম নিয়েছিলেন। দুর্গাপুজোর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে দিনটি। এই দিনেই শুরু হয় পুজোর প্রস্তুতি। রবি ঠাকুর লিখে গিয়েছেন, ‘আশ্বিনের মাঝামাঝি উঠিল বাজনা বাজি, পূজার সময় এল কাছে।’ আশ্বিন এলেই মন বলে ওঠে, মা আসছে। দেবী আরাধনার চারটি দিনের অপেক্ষায় কাটে গোটা বছর। কিন্তু পুজো মানেই তো কেবল চারটি দিন নয়। 

জন্মাষ্টমীর মতো তিথি ঘিরে শুরু হয় পুজোর প্রস্তুতি। সেও তো পুজোরই অঙ্গ। জন্মাষ্টমীর পনেরো দিন পর হয় রাধাষ্টমী তার পনেরো দিন পর হয় জিতাষ্টমী। দুর্গাপুজোর অষ্টমীর এক পক্ষকাল আগের এই তিথিতে জীমূতবাহনের পুজো হয়। বলা হয়, ‘জিতার ডালায় বোধন আসে।’ কারণ, জিতাষ্টমীর পর দিন কৃষ্ণানবম্যাদি কল্পারম্ভ বোধন হয়। অর্থাৎ দুর্গাপূজার সাতটি কল্পের মধ্যে প্রথম কল্পের বোধন। তিথি অনুযায়ী, কৃষ্ণপক্ষের নবমী থেকে মল্লরাজাদের দুর্গাপুজো আরম্ভ হয়, এই তিথিতেই বেদিতে ওঠেন শোভাবাজার রাজবাড়ির দেবী দুর্গা। অর্থাৎ জন্মাষ্টমী এসে পড়া মানেই পুজোর ‘ফাইনাল কাউন্ট ডাউন’ শুরু!

জন্মাষ্টমীর দিন বেলুড় মঠে দেবী দুর্গার কাঠামো পুজো হয়। স্বামী বিবেকানন্দের আমল থেকে এই নিয়ম মানা হচ্ছে। হাওড়ার খসমরা গ্রামের ঘোষবাড়ির দুর্গার কাঠামোও কৃষ্ণের জন্মতিথিতে পুজো পায়। তারপর শুরু হয় খড় বাঁধা। রাজেন্দ্রনাথ মল্লিকদের জ্ঞাতিদের বাড়িতে জন্মাষ্টমীতেই দুর্গা প্রতিমার কাঠামো পুজো হয়। জন্মাষ্টমীর পরদিন হয় নন্দোৎসব। ওইদিন জলপাইগুড়ির বৈকুণ্ঠপুর রাজবাড়িতে মূর্তি গড়া আরম্ভ হয় কাদা-মাটি খেলার মধ্য দিয়ে। দধিকাদো খেলার আয়োজন করেন রাজবাড়ির সদস্যরা। কাঠামো পুজোর পর নাটমন্দিরের পাশে ‘কাদা খেলার পুকুর’-এ কাদামাটির সঙ্গে দই মিশিয়ে দেন পুরোহিত। এরপর তরুণরা দধিকাদো খেলা শুরু করেন। কাদা খেলার মাটি রেখে দেওয়া হয় নাটমন্দিরে। প্রতিমা গড়ার সময় ওই কাদামাটি প্রতিমা গড়ার এঁটেল মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়। 

উত্তর কলকাতার লাহা বাড়িতে জন্মাষ্টমীর পর নন্দোৎসব থেকে পুজোর প্রস্তুতি শুরু হয়। নন্দোৎসবের দিন লাহা পরিবারে দেবীর কাঠামো পুজো হয়। সেই সঙ্গে হয় গণেশ বন্দনা। সেই গণেশই দুর্গার সঙ্গে থাকা গণেশের মূর্তির ভিতর ঢুকিয়ে দেওয়া হয় মূর্তি গড়ার সময়।

জন্মাষ্টমী কিন্তু দেবী মহামায়ারও জন্ম তিথি। যশোদার গর্ভজাত কৃষ্ণের বোনকে দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান ভেবে কংস আছড়ে মারতে গিয়েছিলেন। তখনই ভবিষ্যদ্বাণী হয়, ‘তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে।’ প্রাচীন রীতিমেনে জন্মাষ্টমীর দিনটিতে দুর্গারও জন্মদিন হিসেবে বহু বড় বাড়ির পুজোয় প্রতিমা গড়ার মাটিপুজো বা কাঠামো পুজোর রীতি পালন করা হয়। পারিবারিক পুজোর বায়নাদারেরা কেউ কেউ এইদিন কুমোরটুলি গিয়েও কাঠামো পুজো দেন। একাকার হয়ে যান দুর্গা ও কৃষ্ণ। এভাবেই কৃষ্ণের উৎসব জন্মাষ্টমী হয়ে ওঠে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবের সূচনা পর্ব।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...