কূর্ম পুরাণে একাধিক শাস্ত্রীয় তত্ত্বের পাশাপাশি চারটি আশ্রমের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। এই পুরাণে বলা হয় যে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা ভগবানের নির্দেশ অনুযায়ী সকল প্রাণীর সৃষ্টি করলেন। তিনি যোগ বলের দ্বারা মারীচি, ভৃগু, আঙ্গিরা, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু, দক্ষ, অত্রি ও বশিষ্ঠের মত ঋষিদের সৃষ্টি করলেন। ব্রহ্মার মুখ থেকে জন্ম হল ব্রাহ্মণদের, ব্রহ্মার কাঁধ থেকে সৃষ্টি হল ক্ষত্রিয়র, উরু থেকে বৈশ্য আর পা থেকে শূদ্রদের সৃষ্টি হল। প্রাচীনকালে প্রত্যেকটি মানুষের চিত্ত ছিল শুদ্ধ। তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ধর্ম পালন করতেন এবং ভগবান বিমুখ মানুষ বা নাস্তিক মানুষ তখন সেভাবে চোখে পড়ত না। প্রত্যেকের মনের মধ্যেই ভগবান বা সর্বশক্তিময় সত্তার প্রতি এক স্থির বিশ্বাস ছিল।
এই চার আশ্রমের মানুষ আবার ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম পালন করতেন। কূর্ম পুরাণ অনুযায়ী, "ব্রাহ্মণদের ধর্ম ছিল যজন, যাজন, দান, পরিগ্রহ, অধ্যাপন ও অধ্যায়ন। ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের ধর্ম হিসেবে যদিও দান, অধ্যায়ন ও যজ্ঞের কথা বলা হয়েছে, দণ্ডধারণ এবং যুদ্ধ ক্ষত্রিদের পক্ষে আর কৃষিকার্য বৈশ্যদের পক্ষে প্রশস্ত, শূদ্ররা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের সেবা করে ধর্মলাভ করবে। এছাড়া কারুশিল্প আর পাকযজ্ঞ প্রভৃতি কাজও তারা করতে পারে।" এইভাবে প্রাচীনকালে চারটি আশ্রমের জন্য চারটি কর্ম পৃথক করা হয়েছিল। এছাড়া অতিথিদের সেবা, যজ্ঞ, দান ও দেবপূজা গৃহস্থের সাধারণ ধর্ম হিসেবে বিবেচিত ছিল। বানপ্রস্থের ধর্ম ছিল হোম, ফলমূল ভক্ষণ, ভিক্ষালব্ধ অন্ন ভক্ষণ, বেদপাঠ, তপস্যা ইত্যাদি। ব্রহ্মচারী ও সন্ন্যাসী মানুষদের জন্য ব্রহ্মচর্য ছিল আদর্শ। সন্ন্যাস সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম এবং এই ধর্মের যারা পালন করবেন তারা চিরকাল একটা নিষ্কলুষ জীবনযাত্রার মধ্যে নিজেদের জীবনকে অতিবাহিত করবেন।
তবে ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ এই তিন আশ্রমের মধ্যে গৃহস্থাশ্রমকেই বেশি উপজীব্য ও শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে। বেদে বলা হয়েছে যে, গৃহস্থাশ্রমই ধর্মসাধনের একমাত্র উপায়। এই আশ্রম যদি কেউ সঠিকভাবে পালন করেন তাহলে তার ভগবত প্রাপ্তি হয়। এরপর কূর্ম পুরাণে ধর্ম সম্পর্কে বলা হয়েছে, "ধর্মই ইপ্সিত বস্তু দান করে আর ধর্মই মোক্ষের কারণ, ধর্ম, অর্থ, কাম- এই ত্রিবর্গই সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ তিন গুণ বলে কথিত হয়েছে। সত্ত্বগুণকে অবলম্বন করবেন যে, সকল পুরুষ, তারা গমন করেন ঊর্ধ্বলোকে ও রজোগুণকে আশ্রয় করেন যারা তারা মধ্যস্থানে ও তমোগুণের শরণকারীরা অধোদেশে পতিত হন।"
যিনি ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষের গুনের কথা জানেন ও তার অনুষ্ঠান করেন, তিনি অর্থ ও কাম ত্যাগ করে ধর্মকে আশ্রয় করবেন। ধর্ম বলতে এই পুরাণে বলা হয়েছে এমন এক শক্তি যা স্থাবর, জঙ্গম ও চরাচরকে ধরে আছে। ধর্মই আদি এবং ধর্মই অনন্ত ব্রহ্ম শক্তি। কিন্তু এই ধর্ম মূলত কীভাবে পালন করা যায়? কূর্ম পুরাণ মতে, জ্ঞানমূলক কর্মের দ্বারাই ধর্মলাভ হয়। কোনও ব্যক্তি যদি জ্ঞানের দ্বারা বিচার বিবেচনা করে কর্ম করে থাকেন, তবে তিনি প্রকৃতপক্ষে ধার্মিক। কারণ জ্ঞান অর্থে আলো আর যেখানে জ্ঞান আছে, সেখানে কোন অন্যায় নেই ক্ররতা নেই, রয়েছে ক্ষমা, সংযম, দয়া, দান, লোভশূন্যতা, ত্যাগ, সারল্য, সত্যকথন ইত্যাদি আর প্রকৃতপক্ষে এই বিষয়গুলোকেই চতুর্বর্ণের সাধারণ ধর্ম বলে উল্লেখ করা হয়েছে কূর্ম পুরাণে। তাই কোনও ব্যক্তি যদি তার সমগ্র জীবনে কপটাচার না করে নিষ্পাপ থাকেন, হিংসা মুক্ত ভাবে জীবন যাপন করেন তবে তিনি ধর্ম পালন করছেন এটা বলা যায়.