বইপাড়ার পানের কথাঃ পর্ব ১

মাত্র পাঁচ বছর হল ইংরেজরা পলাশীর যুদ্ধ জিতেছে। ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠা কার্যত সুনিশ্চিত করে ফেলেছেন ব্রিটিশরা। সেই সঙ্গে, ব্যবসা বিস্তারেও মন নিবেশ করছে ইংরেজ বণিকেরা। তবে, শুধু ব্যবসা করলেই তো হলো না।  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মী ও সেনা এবং ইংরেজ বণিকদের বিনোদনের জন্যেও কিছু ব্যবস্থা করতে হবে। তাঁদের আড্ডা-আলোচনায় অবসর যাপনের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
 
 তখনই উইলিয়াম পার্কেসের মাথায় এল, কফির কাপে আড্ডার ফন্দি। কফির সঙ্গে বরাবরই সাহেবিয়ানার একটা সম্পর্ক রয়েছে। পার্কেস ঠিক করলেন, শহরের এক প্রান্তে বাগানবাড়ি কিনে সেখানে 'কফি রুম' বানাবেন। সেই মতো প্রস্তাব পাঠালেন ব্রিটিশ সরকারের কাছে। প্রস্তাবটি লুফে নেন কোম্পানির কর্তৃপক্ষেরা। 
 
কিন্তু একটা আশংকা ছিলই। কোম্পানির তরুণ প্রজন্ম আমোদ-প্রমোদে ভেসে গেলে সর্বনাশ! ব্যবসা লাটে উঠবে। তাই কোন্পানি এর সমাধান খুঁজতে বললো, অনুমতি মিলতে পারে  একটি মাত্র শর্তে—সকালবেলায় অফিসের সময়ে আড্ডাখানা 'কফি রুম' বন্ধ রাখতে হবে। তবে কোনও মৌখিক শর্ত ছিল না। পুরোদস্তুর আইন প্রণয়ন করল কোম্পানি। সেই আইন মেনেই পার্কেস চালু করলেন তাঁর 'লন্ডন হোটেল'। এই হোটেলেই বেশ সাজানো-গোছানো 'কফি রুম' বানালেন তিনি। সময়টা ১৭৬২ সালের ২১শে জুন। কলকাতায় কফি-কালচারের জন্ম। 
cf-1
 
 এই ঘটনার প্রায় দেড়শো বছর পরে কলেজ স্ট্রিটে কফি হাউস তৈরি হয়। অনেকেরই একটি বদ্ধমূল ধারণা রয়েছে, এটাই বোধহয় কলকাতার প্রথম কফি হাউস। আসলে তা সত্য নয়, আজকের বাঙালির কফি-আড্ডার জন্মদাতা কিন্তু পার্কেস সাহেবই। কোম্পানির এক ইংরেজ কর্মচারীর লেখা থেকে জানা যায়, লন্ডন হোটেলে সে সময়ে খাবারের দাম ছিল অত্যন্ত কম। ১৭৮০ সালে এক ডিশ কফির দাম ছিল মাত্র পঁচিশ পয়সা। সময় কাটানোর জন্য ছিল অঢেল ইংরেজি কাগজ এবং বই।
 
কিন্তু দিন যত এগোতে শুরু করে, লন্ডন হোটেলের ওই ছোট কফি রুম কোম্পানির তরুণ কর্মীদের, মন ভরাতে পারে না। আরও জায়গা চাই— এমন দাবি উঠল। তাই বাধ্য হয়ে ১৭৮৮ সালে তৈরি হল ক্যালকাটা এক্সচেঞ্জ কফি হাউস। অবশ্য শুধুই কলকাতায় কর্মরত কোম্পানির কর্তাব্যক্তি, কর্মচারী এবং বণিকদের জন্য এটি নির্মাণ করা হলো। তবে কফি হাউসের সদস্য হওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। মাসিক চাঁদা ৪ টাকা। এখানে রাখা থাকত কলকাতা, লন্ডন এবং মাদ্রাজের সমস্ত ইংরেজি কাগজ এবং রাজনৈতিক খবরের একাধিক পত্রিকা। দিব্যি জমে উঠেছিল সেই কফি হাউসের আড্ডাও। হঠাৎই একদিন বদলে গেল জমজমাট চিত্রটা। কারণ একটাই, সেটা হল লোকসান। 
আড্ডা জমলেও ব্যবসা তেমন জমে ওঠেনি। অগত্যা মালিক কফি হাউসটি বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন। তখনই বেঁকে বসেন হাউসের সদস্যরা।  ঠিক হয়, কফি হাউস বাঁচাতে লটারি করা হবে। তাতেও শেষরক্ষা হয়নি!
নিলামের সঙ্গেই শেষ হয়ে যায় কলকাতার কফি প্রেমের এক অজানা অধ্যায়। প্রাসাদোপম বাড়িটি রয়েগিয়েছে শহরের বুকেই, কিন্তু ক্যালকাটা এক্সচেঞ্জ কফি হাউস নামে, আর কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় না। বর্তমানে সেটি রয়্যাল এক্সচেঞ্জ নামে পরিচিত। 
cf-2
 
লন্ডন হোটেলে কলকাতায় প্রথম 'কফি রুম'-এর প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম পার্কেসের; মূল উদ্দেশ্য ছিল, ব্রিটিশ যুবকরা যাতে বিপথগামী না হন। দিন যত গড়িয়েছে, কলকাতা শহরে সাহেব-মেমদের ভিড় বেড়েছে। ব্রিটিশ যুবকেরা ক্রমেই নেশাসক্ত হয়ে পড়ে। ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি! কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না কেউই, আলাপ-আলোচনা চলছে। এই সময়ে ক্যাপ্টেন হেনরি পিডিংটন একটা উপায় আবিষ্কার করলেন।
 
তিনি ছিলেন একজন সফল বিজ্ঞানী এবং ভূতত্ত্ব, উদ্ভিদবিদ্যা, খনিজতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয়েও তিনি পারদর্শী ছিলেন। পিডিংটন প্রস্তাব দিলেন, মাদকের নেশা থেকে ব্রিটিশ যুবকদের ফেরাতে মোক্ষম দাওয়াই হতে পারে কফি। প্রায় একশো বছর পর ১৮৪৮ সালে, কলকাতায় কফি-আড্ডাকে কার্যত আন্দোলনের রূপ দিলেন পিডিংটন। যার অন্যতম ঠেক ছিল 'অ্যালবার্ট হল'। একেবারে সাহেবি নাম হলেও কাজে অবশ্য ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র হয়ে ওঠে এটি। অ্যালবার্ট হলেই নিবেদিতাকে গোটা ভারতবাসীর সামনে পরিচিত করিয়েছিলেন স্বামীজি। এখানে সুভাষচন্দ্রও বক্তৃতা করেছেন। এখানেই প্রতিষ্ঠিত হয় 'ভারতসভা'।
 
স্বাধীনতার পর অ্যালবার্ট হল চল্লিশের দশক থেকে যাত্রা শুরু করে কফি হাউস হিসেবে। তখন থেকেই ১৫, বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট হয়ে উঠল বাঙালির আড্ডার প্রাণকেন্দ্র। শুধু আড্ডা নয়, কফি হাউস হয়ে উঠল বাঙালির মনন সাহিত্য সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। এরপরই যাদবপুরের কফি হাউস গড়ে উঠল। ৮বি মোড়, সিআইটি বাজারের দোতলায় ইন্ডিয়ান কফি হাউসের এই শাখা তৈরী হয়। বই পাড়ার কফি হাউস তৈরি হয়েছিল ১৯৩৬ সালে। এটির জনপ্রিয়তা ও ক্রেতাদের মধ্যে চাহিদা বাড়ায়, কফিহাউস কর্তৃপক্ষ ১৯৬৪ সালে ৮বি-তে কফি হাউস খোলা হয়। হালে নিউটাউনেও একটা কফি হাউস খোলা হয়েছে। যদিও জনপ্রিয়তা ও ঐতিহ্য কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসই সেরা। কলেজ পড়ুয়া, লেখক প্রকাশক থেকে বই ক্রেতা সবার মাস্ট ভিজিট ডেস্টিনেশন হল বইপাড়ার কফি হাউস। সুনীল, শক্তি সৌমিত্রও এখানে আড্ডা মারতেন। এই আড্ডাখানাকে নিয়ে, মান্না দে, সুপর্ণকান্তি ঘোষ আর গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার অর্থাৎ বাংলা গানের অন্যতম সেরা ত্রয়ীর গানও রয়েছে।
 
সুপর্ণকান্তির কথা থেকে জানা যায়, "একদিন দেরি করে বাড়িতে ঢুকছি দেখে বলেছিলেন, 'কী, বাইরে আড্ডা মেরে সময় কাটাচ্ছ?'" এর উত্তরে সুপর্ণ বাবু আড্ডা নিয়ে, বিশেষ করে কফি হাউসের আড্ডা নিয়ে গান লেখার চ্যালেঞ্জ করেছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারকে। এই বিষয় নিয়ে কথাবার্তা শুরু হল, তার মধ্যেই গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার লিখে ফেললেন দুই লাইন,
 'কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই,
কোথায় হারিয়ে গেল সোনালি বিকেলগুলো সেই।'
cf-4
 
পরদিন সকালে গৌরীবাবুর স্ত্রী ফোন করে সুপর্ণকান্তিকে বলেছিলেন, 'কী গান লিখতে দিয়েছিস রে? সারারাত ধরে লিখছেন।'
 
তিনি লিখেছিলেন সেই আড্ডায় গান। গানের শেষ স্তবক নিয়ে নাকি নানান আলোচনা শুরু হয়েছিল গৌরীপ্রসন্ন-সুপর্ণকান্তির মধ্যে, মতের মিল অমিল অনেক হয়েছিল।
সেই সময়ে গৌরীপ্রসন্ন খুব অসুস্থ, চিকিৎসার জন্য চেন্নাইতে যাওয়ার পথে হাওড়া স্টেশনে বসে একটি সিগারেটের প্যাকেটের উল্টো পিঠে লিখেছিলেন এই কালজয়ী গানের শেষ স্তবক। 'সেই সাতজন নেই আজ টেবিলটা তবু আছে সাতটা পেয়ালা আজও খালি নেই...' এক চেনা লোকের হাতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সুপর্ণ বাবুর কাছে।
মান্না দে-র কণ্ঠে সেই গান ইতিহাস তৈরি করে। কফি হাউজের সেই আড্ডাটা বোম্বে শহরে রেকর্ড করলেন মান্না দে। আজ এটি আড্ডা নস্টালজিয়া আর পুরনো বন্ধুত্বের থিম সং। 
cf-5
 
গানটির আবার দ্বিতীয় অংশ হিসেবে, অনেক বছর পর "স্বপ্নের কফি হাউস" নামের একটি গান মান্না গেয়েছিলেন। কিন্তু সেই গান এমন জনপ্রয়িতা পায়নি। তবে কফি হাউসের আড্ডা তৈরি হওয়ার আগে গায়ক, সুরকার কেউই কফি হাউসে যাননি। কী একবার যাবেন নাকি? নস্টালজিয়ায় মোড়া বাঙালির আড্ডাখানায় একবার ঘুরে আসতেই পারেন। 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...