খানার কাজিয়া

আহারের এতো বাহার, শুধু ভারতীয় উপমহাদেশেই সম্ভব! খানার এই বাহারের সাথেই খানার কাজিয়াও কম না। খাবার তুমি কার? যে বানাবে তার? না! যে রাসাস্বাদন করবে তার! এই ধরুন আমাদের বাংলার রসগোল্লা নিয়ে তো গোল বাধিয়ে ছিল উড়িষ্যা। যাই হোক শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে, আমরা ছিনিয়ে নিয়েছি রসগোল্লার ভৌগোলিক স্বীকৃতি। আসলে বাংলায় সেই ভাবে ছানার প্রচলন ছিল না বলেই বিতর্ক বেশ জোরালো হয়ে উঠেছিল।

যদিও উড়িষ্যাবাসীর দাবী যে, তাদের ক্ষীরমোহনই নাকি রসগোল্লা আদিপুরুষ। এটি তারা জগন্নাথদেবের ভোগে অর্ঘ্য হিসেবে দিয়ে আসছে বহু প্রাচীনকাল থেকে, কিন্তু ক্ষীরমোহনের সাথে রসগোল্লার বহু পার্থক্য রয়েছে। প্রথমই রয়েছে বর্ণগত ফারাক, ক্ষীরমোহন কিন্তু সাদা নয় লালচে। ক্ষীরমোহন ছানা ও ক্ষীর মিশিয়ে যেভাবে তৈরি হয়, রসগোল্লা সে'ভাবে গড়ে ওঠে না। ক্ষীরমোহন রসে চোবানো হয় কিন্তু রসগোল্লার রসে ফোটানো হয়। চৈতন্য চরিতামৃতে জগন্নাথের প্রসাদের যে তালিকা পাওয়া যায়, তাতে কোনো জায়গাতেই ক্ষীরমোহনের উল্লেখ নেই। দীর্ঘ সংঘাতের পরে বাংলা জয় করে রসগোল্লার ভৌগলিক স্বত্বের গর্বের অধিকার। ট্র্যাজেডি দেখুন! ২০১৭ সালের ১৪ই নভেম্বর বাংলা পায় রসগোল্লার বার্থ সার্টিফিকেট, ওই দিনই সারা পৃথিবীতে ডায়াবেটিস দিবস হিসেবে উদযাপিত হয় আর বাংলায় পালিত হয় রসগোল্লা দিবস। আসলেই এইসব সমাপতন বাঙালিদের দ্বারাই সম্ভব।

ল্যাংচা নিয়েও অন্ত:জেলা দ্বন্দ্বের শেষ নেই, নদীয়া আর বর্ধমান বেশ লড়ে যায়। যাক ডেজার্টের এই ক্রুসেডের গপ্পো ছেড়ে চলুন একটু মেইনকোর্সে ঢুঁ মারি। বিরিয়ানি! এ খাবারের জনপ্রিয়তা আসমুদ্র হিমাচল। ভারতের বিশেষ বিশেষ প্রান্তে এর স্বাদ ভিন্ন ভিন্ন। যেমন, আমাদের তিলোত্তমায় লখনৌ-এর আওয়াধি বিরিয়ানির বাড়বাড়ন্ত। বিশেষত্ব একটাই আলু, যদিও সেই আলু এক লক্ষ্ণৌবাসিরই দান। 

গার্ডেনরিচ-মেটিয়াবুরুজকে কলকাতার লক্ষ্ণৌ বানানো ওয়াজিদ আলী শাহ নিতান্ত আর্থিক দুরাবস্থা থেকেই, বিরিয়ানিতে মাংসের পরিবর্তে আলু দিয়েছিলেন। তখন তিনি আর লক্ষ্ণৌর গোমতীর তীরের নবাব নন! তাঁর নিজের তৈরী কলকাতার লক্ষ্ণৌ অর্থাৎ মেটিয়াবুরুজ গার্ডেনরিচ চত্বরের বেতাজ নবাব! এই বিরিয়ানির আলুই তাঁকে অমরত্ব দিয়েছে ভোজনবিলাসীদের তৃপ্তির মাধ্যমে, আর ঢাকা পড়ে গেছে চিড়িয়াখানার জন্য  প্রথম পরিকল্পনা করা, ঠুমরি ও কত্থকপ্রেম। মানিকবাবু এবং মুন্সীপ্রেমচাঁদ যদিও কিছুটা চেষ্টা করেছেন।

খাবারের জগতের এই সুপারস্টারের জন্ম কোথায়? কি ভাবে? খাবারটি উপমহাদেশে বিপুল জনপ্রিয়। ইতিহাসবিদেরা মনে করেন, খাবারটি উপমহাদেশের বাইরে থেকে এসেছে। সবারই নজর আফগানিস্তান, ইরান ও অন্যান্য আরব এলাকার দিকে, অর্থাৎ ইসলামীয় পাল্লাই ভারী!

biriyani-chicken

ব্যারাকে জন্ম হয় বিরিয়ানির; মুঘল সম্রাট শাহজাহানের স্ত্রী মমতাজের শখ হল ব্যারাকে যাবেন। মুঘল সেনাদের দেখতে চান তিনি এবং গিয়ে দেখলেন, মুঘল সেনারা দুর্বল আর অপুষ্টিতে ভুগছে। নির্দেশ দিলেন চালের সঙ্গে মাংস মিশিয়ে রান্না করার জন্য সেইসঙ্গে যেন ঘিও থাকে। ঘিয়ে ভাজা হল চাল। মেশানো হল মাংস; ওই স্বাদ কেবল সেনাদের মুখেই লাগল তা না, পৌঁছাল মুঘল দরবার পর্যন্ত। বিরিয়ানির জন্মপ্রসঙ্গে ইতিহাসবিদদের একটি দল মুঘলদের পক্ষে এবং তাঁদের কয়েকটা যুক্তির মধ্যে মমতাজের ওই কাহিনী একটি। এছাড়াও সেনাদের নিয়েই প্রচলিত আছে বিরিয়ানির আরেকটি কাহিনী। তুর্ক-মোঙ্গল শাসক তৈমুর লং মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা দখলে নিয়ে নেন। ১৩৯৮ এর দিকে তৈমুরের নাগালে চলে আসে ভারতের কিছু অংশও। কিন্তু প্রশ্ন একটাই এই এলাকায় সেনাদের খাবার কী হবে? সেনাদের তো হৃষ্টপুষ্ট রাখা চাই। চালের সঙ্গে মিশলো মাংস আর মশলা। বিরিয়ানির স্বাদে তৈমুরের বাহিনী মুগ্ধ!

দক্ষিণ ভারতে যে কাহিনীটা প্রচলিত তার সঙ্গেও সেনারা জড়িত। তামিল সাহিত্যে 'ওন সরু' নামে একটা খাবারের কথা আছে। খ্রিস্টপূর্ব দুই হাজার বছর আগের বিভিন্ন রচনায় ওন সরুর নাম পাওয়া যায় তাতে বলা হয়, তখন যোদ্ধাদের স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য চালের সঙ্গে মাংস, ঘি, হলুদ এবং সঙ্গে আরো বেশ কিছু জিনিস মেশানো হয় এবং তৈরি হয় ওন সরু। ওন সরুই কি বিরিয়ানির আদি রূপ কি না, সেই গবেষণা চলছে। দক্ষিণ ভারতে বিরিয়ানি আনার জন্য আরব ব্যবসায়ীদের কৃতিত্ব রয়েছে, মালাবার উপকূলীয় পথে আরবরা আসতো ব্যবসার জন্য এবং মনে করা হয় যে, তারাই সাথে নিয়ে আসে এই খাবার। বিরিয়ানির উৎস খুঁজতে ইতিহাসবিদদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন ভাষাবিদরাও। একদল বলছেন, বিরিয়ানি শব্দটা এসেছে পার্সি শব্দ 'বিরিয়ান' থেকে। যার অর্থ রান্নার আগে ভেজে নেওয়া। আর পার্সি শব্দ 'ব্রিনিজ' মানে হচ্ছে চাল। এদের দাবি অনুযায়ী বিরিয়ানি জিনিসটা পশ্চিম এশিয়া থেকেই কোনোভাবে ভারতে এসে পৌঁছায়।

Biriyani-alu

বিরিয়ানির কথা হবে আর হায়দ্রাবাদের কথা আসবে না, তা কি হয়? হায়দ্রাবাদের নিজামের কাছেও  লখনৌর নবাবদের মতোই সমাদর পায় বিরিয়ানি। এই দুই অঞ্চলের বিরিয়ানিই ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। ডিজিটাল ভারত তখন শুরু হবো হবো করছে, একটা শিরোনাম মনে করুন তো যার বাংলা তর্জমা অনেকটা এই রকম "একজন ছেষট্টি বছরের মা তাঁর ২৯তম সন্তানের জন্ম দিলেন", মনে পড়ছে? তেলেঙ্গানা তৈরী হলো, আর রসগোল্লার পরে এবার বিরিয়ানি নিয়ে গোল বেধে গেলো, দক্ষিণ ভারতের দুই রাজ্যে। হায়দ্রাবাদ শহরের বিরিয়ানি পৃথিবী বিখ্যাত হয়েছে আগেই।

একসময়ে অন্ধ্রপ্রদেশের রাজধানী ছিল হায়দ্রাবাদ শহর। কিন্তু অন্ধ্র ভেঙ্গে এখন তৈরি হয়েছে নতুন রাজ্য তেলেঙ্গানা। রাজধানী হায়দ্রাবাদ পড়েছে তেলেঙ্গানার ভাগ্যে। অন্ধ্র সরকারের সব দপ্তরই  চলে গেছে, তাদের নতুন তৈরি হওয়া রাজধানী শহর; অমরাবতীতে। পুরনো রাজধানী শহরের সঙ্গে সঙ্গেই, তারা হারাতে বসেছে হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানির ব্র্যান্ড ভ্যালুও। তাই অন্ধ্র চেষ্টা করছে নিজস্ব বিরিয়ানি ব্র্যান্ড তৈরি করতে। খুঁজেও পেয়েছে তারা নিজস্ব এক বিরিয়ানি। এর নাম 'বঙ্গু বিরিয়ানি'। আরাকু উপত্যকার আদিবাসীদের রন্ধনপ্রণালী থেকে এসেছে এই বঙ্গু বিরিয়ানি। এই নামের রহস্য হল বঙ্গু বা বাঁশের খোলে দমে রান্না করা হয় এই বিরিয়ানি। মোটা বাঁশের খোলে রান্না হয় এই বিরিয়ানি, যা হায়দ্রাবাদী, লক্ষ্ণৌ, কলকাতা বিরিয়ানি, কেরালার বিরিয়ানি রান্নার থেকে একেবারে আলাদা পদ্ধতিতে  তৈরী হয়। এখন এই বিরিয়ানি বেশ মনজয় করেছে ভারতীয়দের এবং বাংলাতেও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...