বাংলার মেলা কথা: মালদহ জেলার রামকেলির মেলা

"বাংলার মেলা কথা" নিয়ে মেলা মেলা মেলা কথা বলা— না, না, লেখা হয়ে গেছে এই সিরিজে। এবার মেলা-কথা শেষ। এবারের মতো শেষ পর্বের মেলা নিয়ে দু চার কথা আলোচনা করা যাক। এই পর্বে আমরা মনের চোখ দিয়ে দেখব বাংলার অতি প্রাচীন এক ঐতিহ্যবাহী এবং সুবিখ্যাত মেলা— মালদহ জেলার রামকেলির মেলা।

প্রাচীন বাংলার রাজধানী ছিল গৌড় (বর্তমান মালদহ)। ষোড়শ শতকের শুরুর দিকে গৌড়ের বাদশা ছিলেন হুসেন শাহ। তার আমলে তার মন্ত্রীসভার মন্ত্রী সাকর মল্লিক ও প্রধান মুনশি দবীর খাস বৈষ্ণব ধর্মকে ভালোবেসে আপন করে নিয়েছিলেন। পরবর্তী কালে এই দু'জন রূপ গোস্বামী ও সনাতন গোস্বামী নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। মহাবৈষ্ণব বলে পরিচিত হন রূপ গোস্বামী এবং সনাতন গোস্বামী। সেই গৌড়েরই এক বিখ্যাত গ্রাম রামকেলি।

গৌড়ের নিকটে গঙ্গাতীরে এক গ্রাম।

ব্রাহ্মণ সমাজ তার রামকেলি নাম।।"

বৃন্দাবন দাস রচিত চৈতন্যভাগবত—এ এই গ্রামের উল্লেখ পাওয়া যায়।

Ramkeli-mela-base-01

এই রূপ এবং সনাতন গোস্বামী ১৫০৯ খ্রীষ্টাব্দে রামকেলিতে মদনমোহন মন্দির প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। এই দুই মহাবৈষ্ণবের সঙ্গে দেখা করতে ১৫১৫ খ্রীষ্টাব্দের ১৫ জুন জৈষ্ঠ সংক্রান্তিতে এই রামকেলিতে এসেছিলেন স্বয়ং মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব। তার আগে ভক্তিধর্ম প্রচারে শ্রীচৈতন্যদেব দাক্ষিণাত্য ও ওড়িশায় গিয়েছিলেন। সেখান থেকে মথুরা-বৃন্দাবন যাওয়ার পথে গৌড়ে এসেছিলেন তিনি। তখন রামকেলি গ্রামে তিন দিন ছিলেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু। যেদিন তিনি রামকেলি পৌঁছেছিলেন সেই দিনটি ছিল বাংলায় জ্যৈষ্ঠ সংক্রান্তি। পয়লা আষাঢ় রামকেলিতে শ্রীচৈতন্যদেব নগরকীর্ত্তন নিয়ে বেরিয়েছিলেন। তাতে যোগ দিয়েছিল কয়েক হাজার মানুষ যা দেখে অভিভূত হয়ে যান হোসেন শাহ। রামকেলিতে অবস্থানকালেই তিনি সনাতন ও রূপকে কৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষা দেন। তাঁদের এই মিলন হয়েছিল মদনমোহন মন্দিরের পাশে কেলিকদম্ব ও তমাল গাছের তলায়। মহাপ্রভু ও রূপ-সনাতনের এই মিলন দিনকে স্মরণীয় করে রাখতে রামকেলিতে উৎসব বা মেলা হয়ে আসছে। এটাই মালদা জেলার সব চেয়ে বড় ও প্রাচীন মেলা। বর্তমানে ঐ সময়ে একই সঙ্গে শ্রীশ্রী মদনমোহন জিউ-এর বার্ষিক উৎসবও পালিত হয়। মহা ধূমধাম সহ মদনমোহন ও রাধারানির পুজো হয়। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর আগমনকালকে উপলক্ষ্য করে প্রতিবছর জ্যৈষ্ঠমাসের সংক্রান্তিতে রামকেলিতে ১৫১৫ সালে এই বিশাল মেলার সূত্রপাত হয়েছিল। ৫০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে আসছে এই মেলা। রাজধানী গৌড় যখন ধ্বংস হয়ে যায় তখন মাঝে দুশো বছর (১৭শতক এবং ১৮শতক) এই মেলা বন্ধ ছিল। পরে তা আবার চালু হয়। আগে এই মেলা প্রায় একমাস ধরে চলত। এখন মেলা চলে সাত থেকে দশ দিন।

Ramkeli-mela-base

এই রূপ- সনাতন বৃন্দাবনের আদলে রামকেলিতে আটটি কুণ্ড বা পুকুরও খনন করেছিলেন এবং তাঁরা রামকেলিকে বৈষ্ণবদের পরম পুণ্যভূমি বৃন্দাবনের রূপ দিতে চেয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে রামকেলি 'গুপ্ত বৃন্দাবন' নামে পরিচিতি লাভ করে। রামকেলি মেলাকে 'গুপ্ত বৃন্দাবন মেলা'ও বলা হয়ে থাকে। রামকেলি সম্ভবত ভারতের একমাত্র স্থান যেখানে মহিলারা মাতৃপিণ্ড দান করেন। মেলার প্রথমদিনে মাতৃপিণ্ড দান করতে বিহার, ঝাড়খন্ড, ওড়িশা থেকে মহিলা ভক্তরা রামকেলি মেলায় ভিড় করে আসেন। ভোর পাঁচটা থেকে বেলা বারোটা পর্যন্ত পিণ্ডদান চলে।

যেহেতু এই মেলা মূলতঃ বৈষ্ণবদের, তাই মেলার সময় রামকেলিতে প্রচুর বৈষ্ণব আখড়া তৈরি হয় এবং সেখানে কয়েক দিনের জন্য আশ্রয় নেন দূর-দূরান্ত থেকে আসা বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীরা। এই রামকেলি মেলা বৈষ্ণব সমাজের বিয়ের জন্যও প্রসিদ্ধ। মালাবদল (কণ্ঠী বদল) করেই গান্ধর্ব মতে বিয়ের অনুষ্ঠান পালন করে থাকেন বৈষ্ণব বৈষ্ণবীরা। আষাঢ় মাসের প্রথম ও দ্বিতীয় দিন মন্দির প্রাঙ্গণে কীর্ত্তন, পালাগান, বাউলগানের আসর বসে। কীর্তন এই মেলার অন্যতম আকর্ষণ।

গ্ৰামের মানুষদের পছন্দসই জিনিসপত্রের সম্ভার নিয়ে ব্যবসায়ীরা হাজির হন দূরের এবং কাছের শহরগুলি থেকে। মালদার বিখ্যাত মিঠাই বিক্রি হয় রমরমিয়ে। পাওয়া যায় পশমবস্ত্র, রেশমের কাপড়, আসন এমনকি শীতলপাটির খোঁজও। যেহেতু এই মেলা গ্রীষ্মের মেলা, তাই এই মেলার অন্যতম আকর্ষণ হল মালদা জেলার বিখ্যাত আম। দশ দিন ধরে প্রচুর কেনাকাটা বিকিকিনির শেষে মেলা ভাঙে। শুরু হয় পরের বছরের মেলার জন্য অপেক্ষা।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...