বাংলার মেলা কথা: দেগঙ্গা বেড়াচাঁপার বাসন্তী পুজোর মেলা

অশুভ শক্তির বিনাশের জন্য মানুষ বহু যুগ ধরে আদ্যাশক্তি মহামায়ার আরাধনা করেছেন। কখনো দেবী দুর্গা রূপে, কখনো দেবী কালীর রূপে, কখনো মা জগদ্ধাত্রী রূপে, আবার কখনো জগজ্জননী দেবী অন্নপূর্ণা বাসন্তী রূপে। এই সবগুলোই মহামায়ার বিশেষ বিশেষ রূপ। এই দুর্গাই মহামায়া রূপে সমগ্র জগৎকে ধারণ করে রেখেছেন – তিনি নিত্যা এবং ত্রিগুণাত্মকা।এই মহামায়াই জগতের সৃষ্টিতে সৃষ্টিশক্তিরূপিনী, তিনিই এই ত্রিভুবনের পালনকারিনী স্থিতিশক্তিরূপা এবং প্রলয়কালে তিনিই সংহারশক্তিস্বরূপিনী। তিনিই খড়গধারিণী, ত্রিশূলধারিণী, গদাধারিণী, আবার তিনিই কখনো ধনুর্ধারিণী। অশুভের বিনাশ করে যুগ যুগ ধরে তিনি রক্ষা করে চলেছেন তাঁর সন্তানদের।

সর্বমঙ্গলামঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থসাধিকে

শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরী নারায়নী নমহস্তুতে

সৃষ্টিস্থিতি বিনাশানাং শক্তিভূতে সনাতনী

গুনাশ্রয়ে গুণময়ে নারায়নী নমোহস্তুতে।।

পুরাণ অনুযায়ী চন্দ্র বংশীয় রাজা সুরথ বসন্তকালে দেবী মহামায়ার আরাধনা করেছিলেন, আবার রামায়ণ অনুসারে শ্রী রামচন্দ্র শরৎকালে রাবণের বিনাশ চেয়ে দেবীর আরাধনা করেছিলেন। তবে বসন্তকাল বা শরৎ কালই হোক আরাধনা করি আমরা জগজ্জননী দেবী মহামায়ারই। 

বেদে কিন্তু দুর্গা নামটির উল্লেখ পাওয়া যায় না তবে পরবর্তী যুগে বিভিন্ন গ্ৰন্থে এই দেবীর উল্লেখ রয়েছে। মহাভারতে বিভিন্ন পর্বে দেবীর নাম এবং তাঁর স্তোত্র রচিত আছে। ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণে, সৃষ্টির একেবারে প্রথম দিকে শ্রীকৃষ্ণ গোলকের রাসমণ্ডলে দেবীর পুজো করেছিলেন এবং পরবর্তী কালে মধু ও কৈটভ নামক দৈত্যদের ভয়ে ব্রহ্মা দেবী মহামায়ার পুজো করেছিলেন এমনটাই লিখিত রয়েছে। ঋষি দুর্বাসার শাপে দেবরাজ ইন্দ্র রূপহীন হয়ে গিয়ে পুনর্বার শ্রীলাভের জন্য দেবীর পুজো করেছিলেন।

এর পর ঋষি মেধসের পরামর্শে মহারাজা সুরথ বসন্তকালে মৃন্ময়ী প্রতিমায় দেবী দুর্গার পুজো করেন। এবং এই ঘটনা রামায়ন রচনার বহু পূর্বের। এই বসন্তকালে দেবীর আরাধনা করা হয়েছিল বলে এই পুজোকে বাসন্তী পুজো বলা হয়।সুতরাং শরতের রামচন্দ্র দ্বারা অকাল বোধন যেমন দেবী দুর্গার আরাধনা,বাসন্তী পুজো তেমনই বসন্তের দুর্গা পুজো, দেবী দুর্গাকেই পুজো করা। নিয়মের বা পুজো পদ্ধতির সামান্য কিছু পার্থক্য থাকলেও এই দুই পুজোরই মূল রীতি একই। দোল পূর্ণিমার পরের যে শুক্লপক্ষ আসে তার ষষ্ঠীতেই মায়ের পুজোর বোধন হয়। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী এই চার তিথিতেই দেবীর পুজো হয়।

বাসন্তী পুজো সম্পর্কে এতগুলো তথ্য জানানো এই কারণেই যে এই সপ্তাহের মেলা কথায় পাঠক বন্ধুরা এই লেখিকার সঙ্গে যাবেন উত্তর চব্বিশ পরগনার বেড়াচাঁপা বাসন্তী পুজো উপলক্ষে অনুষ্ঠিত মেলায়। বাসন্তী পুজো যদিও পারিবারিক উৎসব হিসেবেই সীমাবদ্ধ রয়ে গিয়েছে, এই প্রবল গরমে আর এই সময়ে সর্বজনীন ভাবে পূজিতা হন না দেবী কিন্তু উত্তর চব্বিশ পরগনার বেড়াচাঁপায় বিশাল ধূমধাম করে বিভিন্ন ক্লাব দ্বারা বাসন্তীপুজোর আয়োজন করা হয়। এই এলাকার বয়স্ক মানুষরা বলেন যে একশো বছরেরও বেশি আগে ওই অঞ্চলের মণ্ডল এবং বিশ্বাস বাড়ির জমিদারেরা বেড়াচাঁপা গ্রামের মানুষকে নিয়ে গ্ৰামেই বারোয়ারী বাসন্তী পুজোর আয়োজন করেছিলেন। ওই সময়ে বাঁশের মাথায় সামিয়ানা টানিয়ে তার নিচে প্রতিমা বসানো হত। পুজোর দিনগুলিতে সেই সময় থেকেই মেলাও বসত, সাথে গ্রামবাসীদের আনন্দ দিতে যাত্রাপালার আয়োজন করা হত। 

বর্তমানে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই পুজোতেও লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। শহরের পুজোর ধাঁচে কোথাও ঝিনুকের উপরে মুক্ত দিয়ে তৈরি প্রতিমা। আবার কোনও ক্লাব থেকে বানানো হয়েছে অ্যালুমিনিয়াম পাতের উপরে সুন্দর কারুকাজের পুরনো জমিদার বাড়ির ধরণের পুজো মণ্ডপ। প্লাস্টিকের চামচ দিয়ে তৈরি পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের আদলে কোনো পুজোমণ্ডপ তৈরি করা হয়েছে। বাসন্তী পুজোকে কেন্দ্র করে কলকাতার দুর্গা পুজোর মতোই নানা ‘থিমে’ সেজে ওঠে উত্তর ২৪ পরগনার দেগঙ্গার বেড়াচাঁপা। উপরি আকর্ষণ থাকে চন্দননগরের আলো। সপ্তমী থেকে দশমী চারদিনের পুজোর এবং মেলার ভীড় সামলাতে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকরা এবং পুলিশ নাজেহাল হয়ে পড়ে।

পুজোকমিটিগুলির মধ্যে চলে একে অন্যকে টেক্কা দেওয়ার প্রতিযোগিতা। হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে জমজমাট হয়ে ওঠে মেলা। খেলনা, রকমারি খাবারের সম্ভার, জামা কাপড়, গৃহস্থালির টুকিটাকি, নানান রকম জয়রাইডস, বাঁশি, কাঁচের চুড়ি, ঝুটো গহনা সমস্ত কিছু পাওয়া যায় এই মেলাতে। দোলের পরে যে শুক্লপক্ষ আসে সেই শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী থেকে পুজো এবং মেলা দুইই শুরু হয়ে যায়। খুশির সাগরে যেন ভাসতে থাকে এই অঞ্চলের মানুষ। বাইরের জেলাগুলো থেকেও প্রচুর মানুষ আসেন বেড়াচাঁপার বাসন্তী পুজো দেখতে এবং মেলায় ঘুরতে। দশমীর দিন প্রতিমা বরণ, সিঁদুর খেলা এবং বিসর্জনের সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয় এই মেলা।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...