নিজের রাজ্য রক্ষা করার জন্য আত্মাহুতি দিতে পিছপা হননি এই বীরাঙ্গনা রানী

মুঘলদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা হয়েছে তখন ভারতে। ক্ষুদ্র রাজ্যগুলোও দখল করার চেষ্টা করছে মোঘলবাহিনী। গড়মন্ডল নামের একটা ছোট্ট রাজ্য ছিল। সেখানকার বৈষ্ণব রাজা দলপতি রায়ের রাণী ছিলেন দুর্গাবতী। এই রাজার অনেক রাণী ছিল। রাণী দুর্গাবতী ছিলেন মুখ্যপত্নী। রাণী দুর্গাবতী ছোট থেকেই সাহসী এবং বিদূষী ছিলেন। সহমর্মিতা এবং সুশাসনের সোনার কাঠি ছুঁইয়ে তিনি গড়মন্ডল রাজ্যকে ভরিয়ে তুলেছিলেন সুখ ও শান্তিতে। তার নাবালক পুত্র বীর-নারায়ণের অভিভাবিকা হিসেবেই রাজ্য শাসন করতেন তিনি।

সকল প্রজার কথা, তাঁদের ইচ্ছে, অনুরোধ নতমুখে শুনতেন। সমাধান করার চেষ্টা করতেন। নানান ঐতিহাসিক গ্রন্থে রাণী দুর্গাবতীর কথা পাওয়া যায়।

গড়মণ্ডলে তখন রমরম করে রাজত্ব চলছে। মুঘল বাহিনীর কাছে এই খবর পৌঁছে গেছে যে, গড়মন্ডল নামে একটি ছোট্ট রাজ্য ভারতবর্ষে নিজের জায়গা করে নিচ্ছে।

সুযোগ বুঝে আসফ খাঁ আক্রমণ করে গড়মন্ডল। তখন ১৫৬৪ সাল। পশ্চিমের মালব রাজ্য দু'বছর আগেই মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে চলে এসেছিল, এরপর ১৫৬৪ সালে গড়মণ্ডলের পালা।

রাণীর অধীনে প্রজারা অত্যন্ত সুখী ছিলেন গড়মণ্ডলে। মুঘল আক্রমণের কথা শুনে তাঁরা আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। তবে কি গড়মণ্ডলের ভাগ্যে অন্ধকার নেমে আসছে? গড়মন্ডল কি তবে পরাধীন হতে চলেছে? এই চিন্তা কুরে কুরে খেতে থাকে গড়মণ্ডলের রাণীকে।

এই সময় রাণী দুর্গাবতী সকলকে অভয় দেন যে, কোন অবস্থাতেই তিনি মুঘলদের হাতে গড়মন্ডলকে সমর্পণ করবেন না। বিনা যুদ্ধে শুধুমাত্র আসফ খাঁর খ্যাতির কথা শুনে আত্মসমর্পণ করবেন না তিনি। প্রজারা বিশ্বাস করেছিলেন রাণীকে।

আসফ খাঁর চিন্তাভাবনা কিন্তু ছিল অন্যরকম। নারীশাসিত রাজ্যে আর যাই হোক যুদ্ধ করতে হবে না তাঁকে, এমনটাই ভেবে রেখেছিলেন আসফ খাঁ। তিনি ভেবে রেখেছিলেন বিনা যুদ্ধেই গড়মন্ডল জয় করে নিতে পারবেন তিনি। কারণ যুদ্ধের নামেই নাকি নারীর অন্তরাত্মা না বলে, অন্তঃপুরবাসিনী নারীর ক্ষেত্রে যুদ্ধ গ্রহণযোগ্য নয়। এমনটাই ভেবেছিলেন আসফ খাঁ। এদিকে হঠাৎ করেই আসফ খাঁর বাহিনীর উপর আক্রমণ করে গড়মন্ডল -এর সৈন্যবাহিনী। প্রথম ক্ষেত্রে শোচনীয় পরাজয় হয়েছিল আসফ খাঁ-র।

তবে এই পরাজয়ের গ্লানি আসফ খাঁ বেশিদিন বইতে পারেননি। আরও সৈন্যবল সংগ্রহ করে অস্ত্রসম্ভার আনিয়ে তিনি গড়মণ্ডলে আক্রমণ করেন। মুঘলদের কামান দিয়ে অবিশ্রান্ত গোলাবর্ষণ চলেছিল। রাণীর সৈন্যবাহিনী পেরে ওঠে না আর।

হাতির পিঠে বসে যুদ্ধ করেছিলেন রানী দুর্গাবতী। তিনি তাঁর অদম্য বিক্রম ও সাহসে কিন্তু কোন ভাটা পড়েনি। রানীর ছেলে বীর-নারায়ণ ও বীর দর্পে যুদ্ধ করেছিল। কিন্তু শত্রুর তীরের কাছে ধরাশায়ী হয় সে।

নিজের সন্তানের দিকেও তাকাননি রাণী। সন্তান রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে পড়ে রয়েছে, রাণী সেই পরিস্থিতিতেও যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন। শেষ দিকে একজন মাত্র সৈনিক রাণীর সঙ্গে ছিলেন, বাকি প্রত্যেকেই হয় আহত নইলে মৃত। রাণী থেমে থাকেননি, হাতির পিঠে চেপে একাকিনী যুদ্ধের পথে এগিয়ে যেতে থাকেন।

হঠাৎ করেই বিপক্ষের একটা তীর এসে তাঁর চোখে লাগে, তারপর তাঁর গলায়। কিন্তু তার মধ্যেও রানী দুর্গাবতী চাইছিলেন যুদ্ধ করতে। তবে তাঁর রক্তহীন কাঁপা হাত অবশেষে যুদ্ধের বিরতি ঘোষণা করে।  অস্ত্র পড়ে যায় হাত থেকে। এদিকে আসফ খাঁ যদি অর্ধমৃত রানীকে বন্দী করেন বা হত্যা করেন, তাঁর আগে রানী নিজেই নিজের বুকে তীর বসিয়ে দেন। রাণীর মৃত্যুর পর গড়মন্ডল মুঘলদের দখলেই চলে যায়। এই বীরাঙ্গনার কাহিনী আজও মেয়েদের উদ্বুদ্ধ করে জীবনের ক্ষেত্রে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...