কলকাতার দুর্গাপুজো: বাঙালি আবেগের বিশ্বজয়

মেয়েরা মায়ের জাত। ' মা' শব্দটার মধ্যেই আছে পরম আশ্রয়- নির্ভরতা। তাই নদী আমাদের মা, ভূমি আমাদের মা, দেশ আমাদের মা। আর সব মায়ের রূপ মূর্ত হয় দশভূজা প্রতিমাতে। আসলে দুর্গা প্রতিমা প্রতি মায়ের এক শক্তিশালী স্নেহময়ী রূপ। যে সর্বশক্তি দিয়ে সব অশুভ কে ত্রিশূলের ফলায় বধ করে আগলে রাখে সন্তানদের- আগলায় সংসারকে। তাই শরতে প্রকৃতি যখন সেজে ওঠে রাণীর সাজে, বাঙালি তখনই প্রস্তুত হয় পাঁচদিন ব্যাপী মাতৃদিবস পালনের জন্য।

বাঙালির কাছে আরেকটি আবেগের ডাকনাম কলকাতা। ব্যস্ত শহরে প্রকৃতির শারদ সাজ দূষণের আবছায়ায় টুকরো টুকরো ভাবে চোখে পড়লেও পাড়ায় পুজো প্যান্ডেলের বাঁশ এসে পড়া, পড়াশোনার হাজার চাপ সামলেও নাটকের রিহার্সালের আওয়াজ জানিয়ে দেয় পুজো এসে গেছে। আর দুর্গাপুজোকে ঘিরে কলকাতাবাসীর এই আবেগ আজ বিশ্বের দরবারে কলকাতাকে চিনিয়েছে নতুন ভাবে। ইউনেস্কো প্রদত্ত হেরিটেজ সম্মান আসলে বাঙালির আবেগের বিশ্বজয়।

কলকাতার দুর্গাপুজোর ইতিহাস বহু পুরনো। তবে আগে দুর্গা আসতেন শুধু অভিজাত বাড়ির ঠাকুর দালানেই। দক্ষিণ কলকাতার সাবর্ণ রায়চৌধুরীর বাড়ির পুজো, মধ্য কলকাতার রাণী রাসমণির বাড়ির পুজো, উত্তর কলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজো, জোড়াসাঁকোর শিবকৃষ্ণ দাঁ’র বাড়ির পুজো, হাটখোলার দত্তবাড়ির পুজো ইত্যাদি আরও অনেক বনেদী বাড়ির পুজো কলকাতায় দুর্গাপুজোর জৌলুসের গোড়াপত্তন করেছিল।

সেসময় দুর্গাপূজা ছিল অভিজাত বাড়ির বৈভবের প্রদর্শনী। কোথাও দেবীর সাজে আবার কোথাও নাচগানের আসরের জৌলুসে প্রত্যেক বাড়ি যেন টেক্কা দিতে চাইত একে অপরকে। ইংরেজ শাসনকালে অনেকেই এই পুজোকে করে তুলেছিলেন শাসকের তোষামোদের আসর। জানা যায়, ১৭৫৭-এর পলাশীর যুদ্ধে জয়ের পর সস্ত্রীক রবার্ট ক্লাইভ আমন্ত্রিত ছিলেন শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গাপূজায়। আবার রাণী রাসমণির বাড়ির পুজোয় নজর দেওয়া হতো প্রজাদের মনোরঞ্জনের দিকে। সেখানে বসতে দেশীয় যাত্রাপালা কবিগানের আসর। বোধন থেকে বিসর্জন সবক্ষেত্রেই ছিল বৈভবের প্রতিযোগিতা।

ঊনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণ নতুন করে ভাবতে শেখালো বঙ্গবাসীকে। নতুন যুগের জোয়ারে মা দুর্গা পেরিয়ে এলেন ধর্মাধর্মের বেড়াজাল। ঘরের মেয়ে উমা হয়ে উঠলেন ভারতমাতা। ঘরে ঘরে আগমনী মাতৃবন্দনা মিশে গেল বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দে মাতরমের সুরে। কমলাকান্তের ভাষায় নবরাগরঙ্গিনী, নববলধারিণী, নবদর্পে দর্পিনী, নবস্বপ্নদর্শিনী।

 

এলো পরিবর্তনের পালা,অভিজাত বাড়িতে অপমানিত কিছু তরুণের তেজে কলকাতায় শুরু হয় বারোয়ারি দুর্গাপুজো। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ১৯১০ সালে কলকাতার ভবানীপুরে বলরাম বসু ঘাট রোডে ভবানীপুর সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভার পক্ষ থেকে কলকাতায় প্রথম বারোয়ারি দুর্গাপূজা আয়োজন করা হয়। এরপর ১৯১১ সালে শ্যামপুকুরে, ১৯১৩ সালে শিকদারবাগানে এবং ১৯১৯ সালে নেবুবাগান বারোয়ারি পুজোর সূচনা হয়। এই নেবুবাগান বারোয়ারি পুজোই বর্তমানে বাগবাজার সর্বজনীন পুজো নামে বিখ্যাত। অল্প কিছুজনের পক্ষে দুর্গাপুজোর বিশাল খরচ যখন আর কুলোনো সম্ভব হলো না, তখন স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে চাঁদা সংগ্রহের মাধ্যমে শুরু হল সর্বজনীন দুর্গাপূজা।

বাগবাজার সর্বজনীন দুর্গোৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রচুর ইতিহাস। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথের ভাতুষ্পুত্রী সরলাদেবী চৌধুরানী, দুর্গাচরণ বন্দোপাধ্যায় প্রমুখ খ্যাতনামা ব্যক্তি জড়িত ছিলেন এই পুজোর সঙ্গে। নেবুতলা বারোয়ারি নাম বদলে 'বাগবাজার সর্বজনীন দুর্গোৎসব ও প্রর্দশনী' এই নতুন নামকরণ করেন দুর্গাচরণ বন্দোপাধ্যায়। দেশাত্মবোধ ও স্বদেশীকতার উন্মেষের জন্য তিনি পুজো প্রাঙ্গনেই শুরু করেন গ্রামীন স্বদেশী শিল্পের প্রদর্শনী। ১৯৩০- ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত নেতাজী ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন বাগবাজারের পুজোর সঙ্গে। সেসময় অষ্টমী পুজোর দিন, বীরাষ্টমী উৎসবে অনুশীলন সমিতির সদস্যরা প্রর্দশন করতেন লাঠিখেলা, শরীরচর্চা প্রভৃতি শারীরিক কসরৎ। এই রীতি শুরু হয়েছিল ১৯৩৬ সালে সরলাদেবী চৌধুরানীর পরিচালনায়। সব মিলিয়ে বাগবাজারের পুজো হয়ে উঠল দেশমাতৃকার পুজো, যেখানে একসঙ্গে মিশে যায় সকল জাত-ধর্ম-বিত্ত।

পিতৃপক্ষের অবসানে দেবীপক্ষের সূচনার ভোরে আকাশবাণী কলকাতা কর্তৃক প্রচারিত 'বিশেষ প্রভাতী অনুষ্ঠান' 'মহিষাসুরমর্দ্দিনী' আবেগপ্রিয় বাঙালির আবেগের আরও এক নাম। সমাজের চোখ রাঙানি কে উপেক্ষা করে কায়েতের ছেলে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের উদাত্ত অথচ মাতৃভক্তিতে আকুল কন্ঠের চন্ডীপাঠ বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশক থেকে শুদ্ধ করে চলেছে বাঙালির অন্তর। ধর্মের গোঁড়ামি কে উড়িয়ে দিয়ে মুসলিম, খ্রিস্টান বাদ্যকারদের নিয়ে বাণীকুমার, পঙ্কজ মল্লিক, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র যে পবিত্র গীতি আলেখ্য সৃষ্টি করেছিলেন তা আজ ইতিহাস। ১৯৬২ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর নতুন নতুন ভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে এক একটি অসামান্য পুজোর উপহার শ্রোতাদের কানে পৌঁছে দিতেন তাঁরা। তবে নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষা করলেও অনুষ্ঠানটির ভক্তির মূল স্রোতে কখনই ভাটা পড়েনি। এই অনুষ্ঠানের আবেদন এতটাই যে ১৯৭৬ সালের মহালয়ার ভোরে তাদের প্রিয় ম্যাটিনি আইডলকেও এই জায়গায় মেনে নিতে পারেনি আকাশবাণীর শ্রোতারা। শ্রোতাদের দাবী মেনে আবার পুরোনো অনুষ্ঠানকেই ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছিল তৎকালীন আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ।

যুগ বদলায়, আসে একবিংশ শতক। সর্বজনীন পুজোর অঙ্গে লাগে নতুন নতুন শৈল্পিক ভাবনার ছোঁয়া, শুরু হয় থিম পুজো‌। কলকাতার পুজোয় আবার শুরু হয় প্রতিযোগিতা- এবার প্রতিযোগিতা হয় এক ক্লাবের সঙ্গে অন্য ক্লাবের। এই প্রতিযোগিতার হাত ধরে আসে বাণিজ্য। বড় বড় বাণিজ্যিক কোম্পানি এখন বিভিন্ন পুজোকে করে তুলেছে তাদের বিজ্ঞাপনের মাধ্যম। ছোট-বড় অনেক ব্যবসায়ীও তাকিয়ে থাকে বছরের এই চারদিনের দিকে। কলকাতার পুজো এখন তাই শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং বৃহত্তর বাণিজ্য ক্ষেত্র।

এই মহামিলন ক্ষেত্র আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃতি লাভ করে ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর। শিক্ষাবিদ তপতী গুহ ঠাকুরতার দীর্ঘ গবেষণা ও ভারত সরকারের উদ্যোগ কলকাতার মুকুটে জুড়েছে নতুন পালক। তাই একথা বললে অত্যুক্তি হয় না যে, যে ভাইটা প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে উঁচুতে উঠে প্যান্ডেলের বাঁশ বাঁধেন, রাত জেগে শেষ করেন প্যান্ডেলের কাজ, যে মৃৎশিল্পী ভীষণ যত্ন নিয়ে তিল তিল করে গড়ে তোলেন দশভূজা আর তাঁর সন্তানদের, যে শিশুটা পুজোর সমস্ত আনন্দকে পেছনে ফেলে বাবার হাত ধরে অন্য পাড়ার প্যান্ডেলে চলে আসে ঢাকের তালে কাঁসর বাজাতে- তাদের সকলের পরিশ্রম, ত্যাগ, সর্বোপরি বাঙালির আবেগ আজ বিশ্বজয় করেছে একালের বঙ্গ সরস্বতীর হাত ধরে। তাই এই জয় শুধুমাত্র আলো ঝলমলে উৎসবের জয় নয়, সেই আলোর রোশনাইয়ের আড়ালে থাকা অনেক ত্যাগেরও বিশ্বজয়।

সকলকে জানাই শারদীয়ার প্রীতি ও শুভেচ্ছা। সকলের পুজো ভালো কাটুক।

 

নিবন্ধকারঃ প্রদীপ্তা কুন্ডু

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...