বাংলার নানান প্রান্তের দোল খেলা

কথায় বলে বাংলার বারো মাসে তেরো পার্বণ, উৎসব প্রিয় বাঙালির অন্যতম প্রিয় উৎসব হল দোল। যা একত্রিত হওয়ার উৎসব, সম্প্রীতির উৎসব। রঙ লাগুক সকলের মনে। শাস্ত্র অনুসারে বছরে বৈষ্ণবীয় উৎসবের শেষ উৎসব হোলি বা দোল উৎসব। ফাল্গুনী পূর্ণিমায় এই উৎসব পালিত হয়। পুরাণেও নানান আঙ্গিকে ধরা দেয় দোল।

কবি গোবিন্দদাসের লিখে গিয়েছেন- ‘‘খেলত ফাগু বৃন্দাবন-চান্দ।। ঋতুপতি মনমথ মনমথ ছান্দ। সুন্দরীগণ কর মণ্ডলি মাঝ। রঙ্গিনি প্রেম তরঙ্গিনী সাজ।। আগু ফাগু দেই নাগরি-নয়নে। অবসরে নাগর চুম্বয়ে বয়নে।।’’ দোল উৎসবের সঙ্গে মিশে আছে জীবনের নানা রং। দোল উৎসবে যেমন মিশে আছে বৈচিত্র, তেমনই বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্নভাবে দোল উদযাপিত হয়। দোল এই উপলক্ষ্যে মেলাও বসে। দোল মানেই কেবল শান্তিনিকেতন নয়। বিষ্ণুপুরে রাস মঞ্চে দোল ধরা দেয় অনন্যতায়। পুরুলিয়ায় লাল মাটির দেশে আবার আরেক রকম দোল। মাদল আর পলাশ, শিমুলে প্রকৃতিও যেন অনন্যতা নিয়ে আসে। কোচবিহারের মদনমোহন মন্দিরেও দোলের উদযাপন চলে। মুর্শিদাবাদের বৈষ্ণবদের আখড়ায় দোলের উদযাপন হয়।

পশ্চিম মেদিনীপুরের বগড়ী কৃষ্ণনগরের কৃষ্ণরায়জীউর দোল আজও সাড়ম্বরে পালিত হয়। কৃষ্ণরায়জীউর মন্দিরটি ১৮৫৫ সালে নির্মিত। শোনা যায়, আগে এখানে রাধার মূর্তিটি ছিল না, পরে সেটি প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন থেকেই প্রতি বছর দোলের সময় উৎসব ও মেলা হয়। আগের দিন চাঁচড় উপলক্ষ্যে বাজি পোড়ানো হয়। পূর্ণিমার দিন হয় মূল উৎসব। এ দিন বিকেলে পাল্কি করে দেবতার বিগ্রহ পুরনো মন্দিরে নিয়ে আসা হয়। দ্বিতীয়া তিথি পর্যন্ত বিগ্রহ এখানেই থাকে। পুরনো মন্দির সংলগ্ন আম বাগানে মেলা বসে। দোলের দিন এখনও বহু মানুষের সমাগম হয়।

 

Dolyatra1

 

দক্ষিণ ২৪ পরগনার রাজপুরে মহাসমারোহে দোল উৎসব। এখানের ব্যতিক্রমী আচার অনুষ্ঠানের মধ্যে ‘দোল ফোঁড়াফুঁড়ি’ উল্লেখ্য। এতে যুবকরা দুটি দলে ভাগ হয়ে যান। এক দল রাধার পক্ষে, আরেক দল কৃষ্ণের পক্ষে। পূজাস্থলে একটি পুরনো সিংহদরজা রয়েছে। এক দল সেই দরজার সামনে দাঁড়ান, আর এক দল তাঁদের বাধা অতিক্রম করে দরজা পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করেন। যে দল যে বার জয়ী হন, তাদের বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। আজও এটি দেখতে বহু মানুষ ভিড় করেন।

নদিয়া জেলা হল দোলের জন্য জগৎবিখ্যাত। শান্তিপুর বিভিন্ন গোস্বামী বাড়িতে এবং শ্যামচাঁদ মন্দিরে অনুষ্ঠিত হয় দোলযাত্রা। দোল উপলক্ষে এখনও পথে হরিনাম সংকীর্তনের মিছিল বের হয়। বিশেষ উল্লেখযোগ্য শ্যামচাঁদ মন্দির প্রঙ্গণে আজও দোল উপলক্ষে এক দিনের একটি মেলা বসে। তবে শুধু দোলের দিন নয়। শান্তিপুরে দোল উৎসব চলতে থাকে পূর্ণিমা থেকে রামনবমী পর্যন্ত। এছাড়াও মায়াপুর, নবদ্বীপের দোল ভিন্ন আঙ্গিকে হয়। কল্যাণীর ঘোষপাড়ার সতীমায়ের মেলা হয়।

কর্তাভজা সম্প্রদায়ের সতীমার মেলা ইতিহাস প্রসিদ্ধ। ‘জয় সতীমা-র জয়’ ধ্বনি-মুখরিত হয় মেলা প্রাঙ্গণ। আবিরে রাঙা মেলা; চারদিক থেকে এলোমেলো ভাবে ওড়ানো হয় ফাগ। মেলার বিভিন্ন জায়গায় আউল, বাউল, ফকির, কিংবা সন্ন্যাসীদের আখড়া থেকে ভেসে আসে ভাবের গান। ভক্তরা ডালিমতলায় মানত করেন, হিমসাগরের জলে স্নান করে পুণ্যার্জন করেন, সতী মায়ের সমাধিতে সিঁদুর আর নোয়া দেন। আর মনস্কামনা পূর্ণ হলে দণ্ডি কেটে কিংবা ভাবের গান গেয়ে জানিয়ে যান কৃতজ্ঞতা।

ডালিমতলার চারপাশে অসংখ্য ডালার দোকান। পুজোর উপকরণ বলতে মাটির সরায় খই-বাতাসা কিংবা মঠ। এই হল পুজোর ডালি। পুজো দিয়ে ভক্তেরা এই মহার্ঘ্য প্রসাদটুকু নিয়েই ঘরে ফিরে যায়। দোলের আগের দিন থেকে দোলের পরে পাঁচ দিন পর্যন্ত চলে উৎসব। একাধিক জনশ্রুতি প্রচলিত রয়েছে আউলেচাঁদ বা আউলচন্দ্র রামশরণ পালসহ একুশ জনকে দীক্ষা দেন। এই রামশরণের স্ত্রীর সরস্বতী দেবী হলেন সতীমা। আউলচন্দ্র মৃতপ্রায় সতীমাকে বাঁচিয়ে তুলেছিলেন।

 

Dolyatra2

 

অন্য একটি কিংবদন্তি অনুসারে, উলা বীরনগরের মহাদেব বারুইয়ের পানের বরজে একটি শিশুকে পাওয়া যায়। শিশুটির নাম হয় পূর্ণচন্দ্র। পরে সাধনায় সিদ্ধিলাভের পরে পূর্ণচন্দ্রের নাম হয় আউলচাঁদ। নানা স্থানে ধর্ম প্রচার ও অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ করে তিনি এই ঘোষপাড়ায় এসেছিলেন। বহু মানুষের বিশ্বাস আউলচাঁদই নবদ্বীপের শ্রীচৈতন্য। বিষ্ণুপ্রিয়ার অভিশাপে তাঁকে আবার জন্মগ্রহণ করতে হয়েছিল। ইনি কর্তাভজাদের কর্তা। সতীমার গর্ভে জন্ম নেন দুলালচাঁদ। লোকবিশ্বাসে এই দুলালচাঁদই হয়ে ওঠেন নবদ্বীপের নিমাইচাঁদের অবতার। তাঁর সময়ই মেলা ও কর্তাভজা সম্প্রদায় ব্যাপক প্রসার ঘটে।

উত্তর ২৪ পরগনার ভাটপাড়ায় দোলের দিন নয়, পঞ্চম দোলের দিন মধ্য ভাটপাড়া অঞ্চলে অমরকৃষ্ণ পাঠশালার কাছে বসে পঞ্চম দোলের মেলা। আজও দাঁড়িয়ে অতীতের দোল মঞ্চটি। তবে পুরনো বিগ্রহটি আজ আর আসে না। মাটির বিগ্রহ স্থাপন করে পূজা করা হয়। বর্ধমানের একাধিক জায়গতেও দোলের সাত দিন পরে দোল উদযাপিত হয়।

দোল সাধারণত বৈষ্ণবীয় উৎসব হলেও বাংলার কোথাও কোথাও শাক্ত দেবী এমনকী হিন্দু ধর্মের অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যেও এই উৎসব পালিত হয়।

পঞ্চদশ শতকে চৈতন্যদেবের সময় থেকে দোল খেলছে বাংলা। তবে শুধু হিন্দুরা নন, দোলের রঙে বহু যুগ ধরে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলে আনন্দ উপভোগ করেছেন। সুবে বাংলার নবাব সুজাউদদৌলা রোশনীবাগে হোলি খেলতেন। আলিবর্দি খাঁও রঙ খেলায় মেতে উঠতেন। শোনা যায়, মুর্শিদাবাদের নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা ইংরেজদের সঙ্গে আলিনগর চুক্তি সেরে তড়িঘড়ি মুর্শিদাবাদ ফিরে গিয়েছিলেন হোলি উৎসবের জন্যে। নবাবের প্রিয় হিরাঝিল প্রাসাদে মহাসমারোহে হোলি উৎসব পালন করা হত। তেমনই ঢাকার নবাব নওয়াজিস মহম্মদ খান পটনা থেকে আগত শওকত জঙ্গের সঙ্গে সাত দিন ধরে মুর্শিদাবাদের মোতিঝিল প্রাসাদে হোলি উৎসব পালন করেছিলেন। তবে শুধু নবাবরা নন, সেই প্রাচীন কাল থেকেই হোলি উৎসবে সাধারণ মুসলমানরাও যোগ দিতেন। এইভাবেই বহু ধর্মের মিলনক্ষেত্র বাংলা হয়ে উঠেছিল পুন্যভূমি।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...