বৈচিত্রের কলকাতার বিচিত্র খাওয়া দাওয়া

ইসলামি খাবারের স্বর্গরাজ্য হল জাকারিয়া স্ট্রিট। রমজান মাসের ইফতারীর খাবার মানেই এই রাস্তা। আজকাল ফুড ভলগিং-এর দৌরাত্বে এ এলাকা আমাদের সবার চেনা। আতর-সুরমাতে, হালিম নিহারী, সুতলি- মালাই কাবাবের গন্ধে ম ম করে এই চত্বর। মাহি আকবরি আর মুর্গ চেঙ্গিসি! হালুয়া ফালুদা নিয়ে কলকাতার রমজান ধরা দেয় এখানেই। আর কলুটোলা থেকে বলাই দত্ত স্ট্রিট ধরে জাকারিয়ার মুখে এগোতেই ঐতিহ্যবাহী বাখরখানি। প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গানটা মনে আছে তো!

তবে আর আগে খানিক খুঁজে দেখা যাক, কলকাতার আরেক ইফতার ডেসটিনেশনের। ফিয়ার্স লেন। আগে এর নাম ছিল, ছুনাম গলি। সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের লেখা অনুযায়ী, এই ছুনাম গলিতে মূলত লেবু বিক্রেতাদের বাস ছিল। ব্রিটিশরা আবার একে বলত, ছুনাগলি।জাকারিয়ায় ফেরা যাক! কে এই জাকারিয়া? কার নামে রাস্তা হল তিলোত্তমায়? উত্তর খুঁজতে জানতে হবে নাখোদা মসজিদের গপ্পো।

মহম্মদ আলি পার্কের উল্টো ফুটপাতেই নাখোদা মসজিদের গলি, কলুটোলা। সেখান থেকেই সোজা রাস্তা এগিয়ে গিয়েছে জাকারিয়া স্ট্রিটে। এই রাস্তার অপর প্রান্ত মিশেছে চিৎপুরে।

এই নাখোদা হল কলকাতা তথা পূর্ব ভারতের অন্যতম বড় মসজিদ। 'নাখোদা' পার্সি শব্দ, যার অর্থ হল স্থানীয় জাহাজ বা লর্ড অব দ্য শিপ। ১০ হাজার মানুষ এখানে একইসঙ্গে বসে নামাজ পড়তে পারেন। এই মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় ১৯২৬ সালে।

 

JAKARIA1

 

সম্রাট আকবরের আগ্রার সমাধির অনুকরণে এটি নির্মিত হয়েছিল। নির্মাণ সম্পূর্ণ হয় ১৯৩৪ সালে। তৎকালীন সময়ে ১৫ লক্ষ টাকা ব্যয়ে তৈরি হয়েছিল মসজিদ। এই মসজিদের  প্রথম মোতিয়ালি অর্থাৎ প্রধান ছিলেন হাজি নূর মহম্মদ জাকারিয়া। তিনি জনহিতকর কাজ করতেন। তাঁর স্মৃতিতেই এই রাস্তাটির নাম হয় 'জাকারিয়া স্ট্রিট'। তবে কেবল হাজি নূর মহম্মদ জাকারিয়া নন, এই নাখোদা মসজিদের গড়ে ওঠার নেপথ্যে রয়েছে দুটি নাম। গুজরাটের কাচ্ছি মেমন জামাতের দুই নেতা আবদুর রহিম ওসমান এবং হাজী নূর মহম্মদ জাকারিয়ার উদ্যোগে গড়ে ওঠে নাখোদা।

তাঁরা দু-জনেই এই অসাধ্য সাধন করলেন। কলকাতা পৌরসভার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বড়া মসজিদের বদলে আরও বড় আরও সুন্দর মসজিদ নির্মাণ করা হবে, তখনই এগিয়ে আসেন এই দু-জন মানুষ। সিংহল, মালদ্বীপ থেকে আনা শঙ্খ এবং কড়ি বিক্রির টাকা থেকেই নাখোদা মসজিদ তৈরির অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছিল। জাকারিয়া পদবি এসেছে আর্মেনিয়ার জাকার থেকে; যার অর্থ 'গড হ্যাজ রিমেম্বারড' অর্থাৎ ইশ্বর যা স্মরণে রেখেছেন এমন। চিৎপুর রোড থেকে যে সরু রাস্তা মহম্মদ আলী পার্কে এসে মিশেছে, সেই সুরতি বাগান লেনকে চওড়া করে এর নাম দেওয়া হয় জাকারিয়া স্ট্রিট, ১৯২৮ সালে। আজ জাকারিয়া স্ট্রিট- নাখোদা মসজিদের পাড়া মানেই খাবার, পদে পদে খানা! বাহারি রকমারি সেই সব খানার স্বাদ নিতে ঢুঁ মারতেই হয় এ পাড়ায়।

একে একে শুরু করি, প্রথমেই ইসলামি খাবারের দুই মানিকজোড় হালিম আর নিহারির কথা বলি। হালিম খাঁটি মধ্য প্রাচ্যের ডিশ, পাকেচক্রে যা হয়ে গেল এই উপমহাদেশীয়। নামটামও বদলে গেল! এই ডিশটি ছাড়া রমজানই সম্পূর্ণ হয় না। হায়দরাবাদ এই রান্নায় সুখ্যাতি অর্জন করেছে। ডাল-মাংস দিয়ে তৈরি একটি পদ যে এত ভালবেসে ফেলবে এই ভারতীয় উপমহাদেশের বাসিন্দারা, তা দেশে হালিমের জনক হায়দরাবাদের নিজামরাও ভাবতে পারেননি।

হালিমের উৎপত্তি হয় হারিস নামে জনপ্রিয় আরব দেশীয় একটি পদ থেকে। হারিসের সবচেয়ে পুরনো লিখিত রেসিপি পাওয়া যায় খ্রিস্টীয় দশম শতকে লেখা বাগদাদী রান্নার বই কিতাব-আল-তাবিখে। এই বইটিতে সংকলন করা হয়েছিল তৎকালীন রাজা বাদশাহদের খাবার টেবিলের উপাদেয় বেশ কিছু খাবারের রন্ধনপ্রণালী। বইটির লেখক আবু মুহাম্মদ আল মুজ্জাফর ইবন সায়ার। ইবন বতুতা তার ভ্রমণ কাহিনীতেও পারস্যে ডাল, ঘি এবং গোশত দিয়ে রান্না করা হারিসের কথা উল্লেখ্য করেছেন।

 

JAKARIA2

 

রন্ধন ইতিহাসবিদ ক্লডিয়া রডেনের মতে উপমহাদেশের হালিম মধ্যপ্রাচ্যের হারিস নামক এক ধরনের ডাল ও মাংসের মিশ্রণ জাতীয় খাবার থেকে উৎপত্তি হয়েছে। হারিশা ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, ইয়ামেন ও আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সকলের কাছে উপাদেয় একটি পদ।

রন্ধন বিশেষজ্ঞ আনিসা হেলউ তার লেবানী রন্ধনশৈলী গ্রন্থে লিখেছেন, লেভান্তে গরিবদের একসাথে খাওয়ানোর জন্য বড় ডেকচিতে হারিশা রান্না করা হত। স্পেনের ইহুদিরা তাদের সাপ্তাহিক পবিত্র দিন সাবাথ বা শনিবারে হারিস রান্না করতেন।

ভারতবর্ষে হারিশার আগমন মুঘলদের মাধ্যমে। দ্বিতীয় মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের আমলে ভারতে হারিশার আগমন হলেও হারিশা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় হুমায়ূনের পুত্র সম্রাট জালাউদ্দিন আকবরের আমলে। সম্রাট হুমায়ূনের সাথে পারস্যের সাফাভি সাম্রাজ্যের সাথে বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। আকবরের আমলে লেখা আবুল ফজলের আইন-এ-আকবরী গ্রন্থে হারিসের উল্লেখ পাওয়া যায়।

হালিমের ভারতে আগমনের গল্প জানতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে অনেকটা পথ! এই ডিশটির পূর্বপুরুষ হল, হারিস। এই হারিস তৈরি হত পারস্য সম্রাট খুসরোর রাজকীয় হেঁশেলে, ষষ্ঠ শতকে। তার প্রকায় এক শতক পরে, দামাস্কাসের খলিফা ইয়েমেন থেকে আগত এক প্রতিনিধি দলের জন্য প্রথম এই পদটি পরিবেশন করেন! এঁরা অনেক দূর থেকে, ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত হয়ে এসেছিলেন, তাই এই ডাল-মাংসের কম্বিনেশনে তাঁদের চটজলদি উদরপূর্তি এবং এনার্জিপূর্তি, দু'টিই হয়েছিল।

তারপর থেকেই এটা প্রায় ট্র্যাডিশনের রূপ পায়। যখনই সৈন্যাবাহিনী যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরত, তাদের পরিবেশন করা হত এই ইনস্ট্যান্ট এনার্জি বুস্টার ডিশটি। ১৪শতকে বিখ্যাত পরিব্রাজক ইবন বতুতার লেখাতেও এই হারিস পরিবেশনের উল্লেখ পাওয়া যায়। মোগল সম্রাট হুমায়ুন যখন শের শাহের কাছে পরাজিত হয়ে পারস্যে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তখন মোগল হেঁশেলেও স্থানীয় পাচক মারফত জায়গা করে নেয় এই হারিস। তবে হারিসের হালিমে রূপান্তর কিন্তু হায়দরাবাদের নিজামের হাত ধরেই!

১৯ শতকে নিজামি রান্নাঘরে হারিস ঢোকে, আসলে এই সময় ইয়েমেনি যোদ্ধার দল চৌশরা নিযুক্ত হয় নিজামের দেহরক্ষী হিসেবে। তাদের একটি গ্রাম দেওয়া হয় বসবাসের জন্য। এই যোদ্ধারা নিজেদের সনাতনী খাবার ও স্থানীয় মালমশলা মিশিয়ে তৈরি করে হারিসের নতুন রূপ হালিম। তখন হালিম হত শুধু গোরুর মাংস দিয়ে এবং নোনতা ও মিষ্টি, দু রকমের হালিমই তৈরি করা হত। চৌশদের কাছ থেকে হালিম আসে নিজামের খানসামাদের কাছে এবং সেখান থেকে নিজামের ব্যক্তিগত ফেভারিট হয়ে ওঠে এই পদটি।

ডাল, গম, মাংস (মূলত বিফ বা মটন, যদিও এখন চিকেন হালিমও পাওয়া যায়), নানা রকমের গরম মশলা দারচিনি, শাজিরে, এলাচ ইত্যাদি, নানা রকমের বাদাম, ঘি, কাজু, কিসমিস, আমন্ড, পেস্তা ইত্যাদি ইত্যাদি দিয়ে হালিম তৈরি হল। এত সব উপকরণ যদি থাকলে, সেই পদ সুস্বাদু তো বটেই, সুখাদ্যও হবে। নানা গুণে সমৃদ্ধ খাবারটি খেয়ে উপবাস ভঙ্গ করলে নাকি সারাদিনের যে পুষ্টিজনিত খামতি, তা অনায়াসে পূরণ করা যায়, সেই কারণের ইফতারি খানা হিসেবে এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন যত রকমের হালিম পাওয়া যাক না কেন, আদপে হালিমের কেবল দুটি প্রকারভেদই আছে, সেটি হল বিফ হালিম এবং মটন হালিম।

পদটি মূলত রমজান মাসেই সব মোগলাই খাবারের দোকানে মেলে। দুপুর চারটে থেকে সন্ধে সাতটা পর্যন্ত আপনি হালিম পেতে পারেন, তারপর সাধারণতই তা শেষ হয়ে যায়। হালিম ঢিমে আঁচে প্রায় ১০-১২ ঘণ্টা ধরে রান্না করাটাই দস্তুর। কলকাতায় জাকারিয়া স্ট্রিটে রমজান মাসে নানা ধরনের হালিম পাওয়া যায়। খাস কলকাতার বুকে জাকারিয়াকেই হালিম পীঠ বলা যায়।

আরেকটি ইসলামি খানা হল নিহারি বা নেহারি। সারা রাত রান্না করা তুলতুলে মাংসের স্যুপ। এ জিনিস সকালে খাওয়ার নিয়ম। তবে সাতটার মধ্যে পৌঁছতে হয়, কারণ নিহারির দোকানগুলোতে ভোর চারটের সময় থেকে লাইন পড়ে কোনও কোনও জায়গায়। সকাল আটটার মধ্যে শেষও হয়ে যায়। তুলতুলে মাংসের মশলাদার ঝোল। নিহারির ইতিকথা সুদীর্ঘ। নিহারী একটি জনপ্রিয় খাদ্য। এটি কেবল

মুসলিমদের মধ্যেই জনপ্রিয় নয়, এখন সকলেই নিহারির স্বাদে মজেছেন। ফারসি ভাষার নিহার শব্দটি থেকে নিহারির উৎপত্তি হয়েছে। যার অর্থ সকাল, এই খাবারটি সকাল বেলায় খাওয়া হয় বলে, এহেন নামকরণ করা হয়েছে। নিহারী হল গরু বা ভেড়ার পায়ের মাংস দিয়ে রান্না করা মসলাযুক্ত ঝোলযুক্ত খাবার। এর চল শুরু হয় শুরুতে দিল্লীত। নিহারী রান্না করার জন্য ভেড়া বা গরুর পায়ের রানের মাংশকে ৬-৮ ঘণ্টা ধরে হাঁড়িতে করে রান্না করা হয়। এর ফলে মাংস নরম তুলতুলে রূপ ধারণ করে। নান রুটি বা লুচির সাথে এটি খাওয়া হয়। কলকাতার জাকারিয়া স্ট্রিটটির দোকানগুলো নিহারি রান্নায় বিপ্লব এনে দিয়েছে। তারাই এ শহরে নিহারিকে বিখ্যাত করেছে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...