পুরীর জগন্নাথদেব কীভাবে এলেন বাংলায়? জানুন বিস্ময়কর কাহিনি

আষাঢ়ের শুক্ল দ্বিতীয়ায় রথে চাপেন জগন্নাথ, বলভদ্রদেব এবং তাঁদের ভগিনী সুভদ্রা। বর্ষার অন্যতম সেরা উৎসব রথযাত্রা। জগন্নাথ কেবল রথেই চাপেন না, সারা বছর বাংলার নানান প্রান্তে তাঁর পুজো চলে। এছাড়াও পরিবারিকভাবেও বহু বাড়িতে জগন্নাথের পুজো হয়। জমিদার, রাজবাড়িগুলোর কুলদেবতা হিসাবেও তিনি বিরাজ করেন। বৈষ্ণব পরিবারগুলোতেও তিনিই আরাধ্য দেব। হুগলির মাহেশ, গুপ্তিপাড়া থেকে বর্ধমানের মালাধর বসুর স্মৃতি বিজড়িত কুলীন গ্রাম, খাস কলকাতার খিদিরপুর; বঙ্গের দিকে দিকে রয়েছে জগন্নাথের মন্দির। প্রায় পাঁচ শতক ধরে মন্দিরগুলোয় পূজিত হচ্ছেন তিন ভাই-বোন। জনপ্রিয় মন্দিরগুলোর পাশাপাশি স্বল্পখ্যাত, অখ্যাত মন্দিরও আছে। 

 

পশ্চিম মেদিনীপুর দাঁতনে রয়েছে এক প্রাচীন জগন্নাথ মন্দির। একদা দাঁতন ছিল উড়িষ্যার অধীনে। দাঁতন থানার শরশঙ্কা গ্রামে রয়েছে এই প্রাচীন জগন্নাথ মন্দির। সম্রাট শাহজাহানের আমলে মন্দিরটি তৈরি হয়েছিল। সুবর্ণরেখার তীরবর্তী অঞ্চলে দাস মহাপাত্র পরিবারের সদস্যরা কর আদায়ের জন্য নিযুক্ত হয়েছিল। পলাশিয়া গ্রামে তাঁরা বসবাস করত। বছর বছর বন্যার কারণে দাস মহাপাত্ররা দাঁতনের শরশঙ্কা এবং আঙ্গুয়ায় চলে আসেন থাকতে। শরশঙ্কা গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন জগন্নাথ মন্দির। মন্দিরের বয়স কমপক্ষে তিনশো বছর। 

 

বাংলায় জগন্নাথ আরাধনার প্রসঙ্গ উঠলেই এসে পড়ে নদীয়ার চাকদহের যশড়া গ্রামের কথা। এখানে রয়েছে এক সুপ্রাচীন জগন্নাথ মন্দির, শ্রীল জগদীশ পণ্ডিতের শ্রীপাট। কেবল পূজিত হন জগন্নাথ, এককভাবেই। সঙ্গে নেই বলরাম ও সুভদ্রা। জনশ্রুতি অনুযায়ী, চাকদহের এই মন্দিরেই বিরাজ করে পুরীর মন্দিরের জগন্নাথ বিগ্রহ। প্রায় পাঁচশো বছর ধরে বাংলার মাটিতে বিরাজ করছেন পুরীর মন্দিরের জগন্নাথদেব। পাঁচশো বছর আগে জগন্নাথকে বৈষ্ণবভূমি নদীয়াতে ঘাড়ে করে বয়ে এনেছিলেন জগদীশ পণ্ডিত। জগদীশ পণ্ডিত ছিলেন চৈতন্যদেবের পিতা জগন্নাথ মিশ্রের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। নিমাইকে খুব স্নেহ করতেন জগদীশ।

 

জনশ্রুতি অনুযায়ী, সন্ন্যাস নিয়ে পুরীধামে থাকবেন নিমাই। এই কথা শোনা মাত্র জগদীশ ভাবলেন যদি জগন্নাথদেবকে বঙ্গভূমিতে নিয়ে আসা হয়, তাহলে নিমাইকে আর পুরীতে গিয়ে থাকতে হয় না। শ্রীক্ষেত্রে সেই সময় জগন্নাথের নবকলেবর চলছিল, জগদীশ জগন্নাথের স্বপ্নাদেশ পেয়ে রাতের অন্ধকারে পুরনো বিগ্রহ নিয়ে, এক প্রকান্ড লাঠি নিয়ে পুটলী বেঁধে বাংলার দিকে রওনা দিলেন। চাকদহে গঙ্গাস্নান করার জন্য বিগ্রহ সমেত ঝোলাটি মাটিতে রাখেন, স্নানের পর ফিরে এসে আর তুলতে পারলেন না, তখন জগন্নাথ দেব তাঁকে স্বপ্নে ওই স্থানেই মূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে আদেশ দিলেন। জগন্নাথ ওখানেই প্রতিষ্ঠিত হলেন। শোনা যায়, বকুল গাছে আম, অশ্বথগাছে কাঁঠাল এবং কুয়োয় দুধ হয়; এসব দিয়েই জগদীশ পণ্ডিত জগন্নাথের পুজো করেছেন।

 

আর একটি মতে, একমাস পায়ে হেঁটে তিনি পুরী গিয়েছিলেন। পুরীতে জগন্নাথদেবকে দর্শনের পর মন খারাপ করে জগদীশ পণ্ডিত বলেছিলেন, তিনি বৃদ্ধ হবেন। চাইলেও আর দেবদর্শনে আসতে পারবেন না। জগন্নাথদেব তখন জগদীশ পণ্ডিতকে বলেন, পুরীর মন্দিরের নবকলেবর হবে। তাঁর নতুন বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা হবে। পুরনো বিগ্রহটি পুরীর মন্দিরের তুলসী বাগানে সমাধিস্থ করা হবে। সেই বিগ্রহটি জগদীশ পণ্ডিত যেন নিয়ে যান। কিন্তু এত বড় মূর্তি নিয়ে যাবেন কীভাবে? শোনা যায়, ভক্ত জগদীশের কষ্ট লাঘবে আকারে ছোট হয়ে গিয়েছিলেন জগন্নাথদেব। কিন্তু শর্ত ছিল, কোথাও রাখলেই বিগ্রহ পুনরায় আগের আকারে ফিরে আসবে। দীর্ঘ পথ লাঠি হাতে কাঁধে বিগ্রহ নিয়ে হেঁটে এসে চাকদহের বর্তমান মন্দিরের কাছে ক্লান্ত জগদীশ বিগ্রহ ধরতে দেন এক সঙ্গীকে। গঙ্গায় নামেন স্নান করতে। বিগ্রহ ফের প্রকাণ্ড রূপ ধারণ করে। এরপর শত চেষ্টাতেও আর তোলা যায়নি সেই মূর্তি। সেখানেই জগন্নাথদেবের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়। কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র একদিন খবর পান, জগন্নাথের মূর্তি তাঁর রাজ্যে উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু তা এত ভারী হয়ে গিয়েছে, যে সরানোর উপায় নেই। চাকদহেই জগন্নাথের জন্য পাঁচশ বিঘা জমি দান করেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র।

 

জগদীশ পণ্ডিত ও তাঁর ভাই মহেশ পণ্ডিত প্রভুর সেবা করতেন। এই মন্দিরে স্বয়ং চৈতন্যদেব এসেছেন। জগদীশপত্নীকে একটি গৌরগোপাল বিগ্রহ দান করেছিলেন নিমাই যা আজও পূজিত হচ্ছে মন্দিরে। সেই লাঠিও রাখা রয়েছে। জগদীশ পণ্ডিতের পুজো করা রাধাবল্লভ, বলরাম, শ্রীকৃষ্ণ, রাধারাণীও পুজো পান। মন্দিরের দেখা মেলে জগন্নাথের বিগ্রহের। পাশে সুভদ্রা এবং বলরাম নেই। জগন্নাথদেবের দারু বিগ্রহটির উচ্চতা ৪ ফুট। এত বৃহৎ আকারের জগন্নাথ খুব একটা দেখা যায় না।

 

মন্দিরে জগন্নাথদেব এবং গৌরগোপালের নিত্যপুজো হয়। প্রতিবছর দুটো উৎসব না মন্দিরে। জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমায় জগন্নাথের স্নানযাত্রা এবং পৌষমাসের শুক্ল তৃতীয় তিথিতে জগদীশ পণ্ডিতের তিরোধান দিবস। জগন্নাথের ইচ্ছা ছিল না তাই রয়েছে রথযাত্রা হয় না। মহাসমারোহে স্নানযাত্রা উৎসব পালিত হয়।

 

অন্যদিকে, যশড়ার নেউলিয়ায় পালপাড়ার মহেশ পণ্ডিতের শ্রীপাটে মালোপাড়ায় বসুধা জাহ্নবী শ্রীপাট অবস্থিত। এখানে আজও পূজিত হন প্রভু নিত‍্যানন্দের হাতে প্রতিষ্ঠিত শালগ্রাম শীলা, জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা। জগন্নাথদেব রথে ওঠেননি অদ্যাবধি। কথিত আছে, চৈতন‍্য মহাপ্রভু দীক্ষা নেওয়ার জন্য নবদ্বীপ ধাম থেকে হাঁটা পথে মালোপাড়ার এক অশত্থ গাছের নিচে বিশ্রাম নিয়েছিলেন। তারপর কুমারহট্টে মাধবেন্দ্র পুরীর শিষ্য ইশ্বরপুরীর কাছে গিয়েছিলেন দীক্ষার জ‍ন‍্য। এর বহু পরে নিত‍্যানন্দ প্রভু চৈতন‍্যদেবকে অনুসরণ করতে করতে এই স্থানে আসেন। যেখানে চৈত‍ন‍্য মহাপ্রভু বিশ্রাম নিয়েছিলেন।সেই জায়গায় দীর্ঘক্ষণ বসে ছিলেন নিত‍্যানন্দ। তারপর তিনি জগন্নাথদেবকে প্রতিষ্ঠা করেন।






এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...