বাড়িটা বেলগাছিয়া ট্রাম ডিপোর কাছে। ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্যকলার সুন্দর নিদর্শন এই বাড়িটা। বাড়িটার বয়স সামান্যই। অন্তত বনেদি ইতিহাস পর্যালোচনা করতে গেলে যে সময়কাল নিয়ে আলোচনা করতে হয়, এই বাড়িটার বয়স তার থেকে অনেকটা কম। বিংশ শতকের শুরুর দিকে তৈরি এই বাড়িটি। কলকাতার মার্টিন বার্ন কোম্পানি বিংশ শতকের শুরুর দিকে বাড়িতে তৈরি করেছিলেন। বাড়িটির নাম কেন ধূর্জটিধাম তা নিয়ে তেমন কোন ঐতিহাসিক তথ্য নেই। ভগবান শিবের অন্য নাম ধূর্জটি। অনুমান করে নেওয়া হয় সেখান থেকেই এই বাড়িটির নাম হয়েছে ধূর্জটিধাম।
ঐতিহাসিকদের মতে এই বাড়িটি গৌরী সেনের বংশধরদের তৈরি। তবে পুত্রদের দিক থেকে নয়, কন্যাদের দিক থেকে গৌরী সেনের বংশধরেরা এই বাড়িটি তৈরি করেছিলেন। যদিও অনেক ঐতিহাসিক এই বাড়িটির যে বংশলতিকাটি পেয়েছেন সেখানে তিনটি নাম পাওয়া গেছে। অযোধ্যাপ্রসাদ, গৌরমোহন এবং রামকৃষ্ণ। অনেকে মনে করেন এই গৌর মোহনই পরবর্তীকালের গৌরী সেন। দান-খয়রাত এবং সম্পত্তি নিয়ে গৌরী সেনের নামে প্রবাদটি সর্বজনবিদিত। এই পরিবার বরাবর দয়ালু ছিল। নানা ক্ষেত্রে দান করেছেন। বিপদগ্রস্ত কোন মানুষকে কখনোই এই পরিবারের দরজা থেকে ফিরে যেতে হয়নি। অনুমান করা হয় গৌরী সেন সপ্তদশ বা অষ্টাদশ শতাব্দীর মানুষ। হুগলি জেলার বালি অথবা বহরমপুরে তাঁর বাড়ি। ব্যবসার মাধ্যমেই প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন তিনি। কলকাতার ধনী ব্যবসায়িকের মধ্যে তাঁকে অন্যতম হিসেবে মানা হয়।
বরিশাল সপ্তগ্রাম থেকে এসে আহিরীটোলায় আরেকটি বাড়ি তৈরী করেছিলেন। অনুমান করে নেওয়া যায়, সপ্তগ্রামে সরস্বতী নদী বুজে যাওয়ার সময় কলকাতায় এসে ব্যবসা করেছিলেন।।
এই গৌরী সেনের মেয়ের তরফের বংশধর নারায়ণ কৃষ্ণ সেন। নারায়ণ কৃষ্ণ সেনের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর বংশ বিলুপ্ত হয়ে যায়। কারণ নারায়ণ কৃষ্ণ তাঁর একমাত্র ছেলে যুগল কিশোরকে ত্যাজ্যপুত্র করেছিলেন। দোষ বলতে তিনি বাবার পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করতে চাননি। নারায়ণ কৃষ্ণের ছোট ভাই প্রিয়লাল এর বাড়ি ধূর্জটিধামের পাশেই। যদিও বাড়িটি বিক্রি হয়ে গেছে। ১৯৩৫ সালে মারা যান নারায়ণ কৃষ্ণ সেন। কলকাতায় ব্রিটিশ স্থাপত্যের সুন্দর নিদর্শন এই বাড়ি। এই বাড়ির সবচেয়ে দর্শনীয় বস্তু দোতলায় ওঠার সিঁড়িটি। মাঝখানে এই দুটি থামের উপর ন্যস্ত থাকায় সিঁড়ি একবার মাত্র বাঁক নিয়ে টানা উঠে গেছে দোতলায়। সুরকির ছাদের মাঝখানে রয়েছে গম্বুজআকৃতির একটি ঘর। যার নাম পিকক রুম। এখানে ময়ূর থাকতো।
বাড়িটিতে সিঁড়ির পাশে দেওয়ালের মাঝখানেই রয়েছে নারায়ণ কৃষ্ণের বিশাল একটি তৈলচিত্র।। বারান্দায় ওঠার মুখে সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে একটি গ্র্যান্ডফাদার ক্লক রয়েছে। লন্ডনের মৃগান কোম্পানির তৈরি।
দক্ষিণমুখী বাড়ি। গাড়ি বারান্দা রয়েছে। শ্বেত পাথরের হাতি ও চীনা কারিগরের তৈরি প্রমাণ সাইজের একটা কাঠের ভাল্লুক রয়েছে বাড়িটিতে।। ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্য কলায় তৈরি এই বাড়ি দেখতে অতি সুন্দর। কলকাতার বনেদি বাড়ির ছোঁয়া রয়েছে। তবে ঔজ্জ্বল্য মলিন হয়ে যায়নি। নীচের বারান্দার ওপরেই রয়েছে রট আয়রনের রেলিং দেওয়া বারান্দা ও তার সামনে একটি ঝুল বারান্দা। ভেতরের নাচ ঘরে ড্রয়িং রুমে সোবার ঘরে লন্ডনের একটি কোম্পানির তৈরি নানা রকম বাতিদান রয়েছে। নারায়ণ কৃষ্ণের আমলে যেভাবে আসবাবপত্রগুলি ছিল আজও সেই ভাবেই রাখা রয়েছে। যেহেতু বাড়িটির বয়স তুলনামূলকভাবে কম, এবং এখনো এই পরিবারের উত্তরসূরীরা বাড়িতে থাকে, রীতিমত রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। নানারকম বাতিদান রয়েছে বাড়িটিতে। ফুলদানিও আছে। এসবই বিভিন্ন কারুকার্য করা যা অত্যন্ত দামি। বিভিন্ন জনসেবামূলক কাজে এই বাড়িটি বহুবার ব্যবহার হয়েছে। এভাবেই কলকাতার বুকে এই বনেদি বাড়ি টিকে রয়েছে।