তিনিই শব, তিনিই শক্তি- বাংলায় কীভাবে শুরু হল জগদ্ধাত্রী পুজো?

শ্রীশিব উবাচ।

আধারভুতে চাধেয়ে ধৃতিরূপে ধুরন্ধারে।

ধ্রুবে ধ্রুবপদে ধীরে জগদ্ধাত্ৰি, নমোহস্তুতে॥১

শবাকারে শক্তিরূপে শক্তিস্থে শক্তিবিগ্ৰহে।

শাক্তাচার-প্ৰিয়ে দেবি জগদ্ধাত্ৰি নমোহস্তুতে॥

 

শ্ৰীশিব বললেন, হে জগদ্ধাত্রী! তুমি নিখিল জগতের আধার ও আধেয় স্বরূপ। তুমি ধৃতিরূপা। তুমি সমস্ত জগতের ভার বহন করছ। তুমি অচল স্বরূপা। জগৎ ধারণ করেও তুমি ধীরভাবে অবস্থিতা রয়েছ তোমাকে নমস্কার৷

তুমি শব, তুমিই শক্তি, তুমিই শক্তিতে অবস্থান করছ, আবার তুমিই শক্তি বিগ্ৰহধারিণী। তুমি শাক্তদের সপ্তাচারে সন্তুষ্টা। হে দেবী! হে জগদ্ধাত্রী! তোমাকে নমস্কার।

IMG-20231120-WA0011

জগৎকে ধারণ করে যিনি থাকেন, তিনিই জগদ্ধাত্রী। সমগ্র জগতের আধার। আদ্যা শক্তি মহামায়ার অন্য রূপ।  তিনি ত্রিনয়না। দেবী জগদ্ধাত্রীর হাতের সংখ্যা চার। দেবী দুর্গার মতই দেবী জগদ্ধাত্রী সিংহবাহিনী। তাঁর গলায় থাকে নাগযজ্ঞোপবীত। দেবীর দুই বাম হাতে থাকে শঙ্খ ও শার্ঙ্গধনু। আর, দুই ডান হাতে থাকে চক্র ও পঞ্চবাণ।

দেবী দুর্গার বাহন সিংহ মহিষের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। আর, দেবী জগদ্ধাত্রীর বাহন সিংহ দাঁড়িয়ে থাকে হাতির ওপর। সংস্কৃতে হাতির অপর নাম করী। কথিত আছে দেবী জগদ্ধাত্রী করী বা হস্তিরূপী অসুর করীন্দ্রাসুরকে বধ করেছিলেন। সেই কারণে তাঁকে বলা হয় করীন্দ্রাসুরনিসূদিণী।

শাস্ত্র মতে মা দুর্গা মর্ত্য থেকে কৈলাসে ফিরে যাওয়ার পর আবার মর্ত্যে ফেরেন দেবী জগদ্ধাত্রী রূপে।কিন্তু এই দেবীর উৎপত্তি ও তার পুজোর কারণ নিয়ে একটি পৌরাণিক ব্যাখ্যাও আছে|

সেই ব্যাখ্যা অনুযায়ী পুরাণ মতে, মা দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করার পর দেবতারা আবার প্রবল অহংকারী হয়ে ওঠেন। ক্ষমতার আস্ফালনে দেবতারা অন্ধ হয়ে যান। যেন তাঁরাই সমস্ত সৃষ্টির অধীশ্বর, তাঁরা ছাড়া আর কারও কোনও শক্তিই নেই!

দেবতাদের এই অহংকার দেখে প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হন ব্রহ্মা। তিনি যক্ষরূপ ধারণ করে দেবতাদের একে একে ডেকে পাঠান। একটি সামান্য ঘাসকে রেখে তিনি পবনদেবকে বলেন তা নিজ ক্ষমতায় সরিয়ে দেখাতে। পবনদেব হাজার চেষ্টার পরেও বিফল হন।

এরপর বরুনদেবকে ডেকে পাঠানো হয় এবং বলা হয় ঘাসটিকে ভিজিয়ে দেখাতে। তিনিও অসফল হন। তারপরে ডাক পরে অগ্নিদেব, তিনিও ঘাসটিকে জ্বালাতে ব্যর্থ হন।

এই ভাবে দেবতাদের দম্ভ চূর্ণ হয়| প্রত্যেকে অসফল হওয়ার পর নিজরূপে আবির্ভূত হন ব্রহ্মা। তিনি দেবতাদের বোঝান যে সবার ওপরে ব্রহ্মই সত্য। তাহার ওপর কেহ না। তিনি আরও বলেন, দেবতাই হোক কিংবা মানব অথবা দৈত্য, এই জগতে সবচেয়ে বড় একটি অসুরের বিরুদ্ধে তাঁদের লড়াই করতে হবে আর সেটি হল তাঁদের মানসিক অহংয়ের অসুর।

IMG-20231120-WA0012

করিন্দ্রাসুর আসলে এই অহং বোধের প্রতিফলন| আর এই অসুরকে বধ করতেই পরম ব্রহ্ম যে দেবীর রূপ নেন, তিনিই জগদ্ধাত্রী।

শ্রীশ্রী চণ্ডীতে অনুসারে দেবী জগদ্ধাত্রী আর দেবী দুর্গা একই। সেখানে বলা হয়েছে যে দেবী দুর্গার সঙ্গে যুদ্ধের সময় মহিষাসুর নানা রূপ ধারণ করে দেবীকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। মহিষাসুর করী বা হাতির রূপও ধারণ করেছিল। সেই সময় দেবী দুর্গা চতুর্ভুজা রূপে আবির্ভূত হন। হাতে ধরা চক্র দিয়ে হাতির শুঁড় কেটে দেন। দেবীর সেই রূপকেই বলে জগদ্ধাত্রী। আর, সেই কারণেই দেবী জগদ্ধাত্রীর বাহন সিংহ এক মৃত হাতির ওপর দাড়িয়ে থাকে।

বাংলায় কীভাবে শুরু হল জগদ্ধাত্রী আরাধনা?

জনশ্রুতি বলে, বাংলায় শান্তিপুরের চন্দ্রচূড় তর্কমুনির কামরাঙা গাছতলায় পঞ্চমুণ্ডির আসনে প্রথম দেবী জগদ্ধাত্রীর পুজো হয়। এই লোকগাথা ঘিরে বিতর্কও রয়েছে।

নথি অনুযায়ী ১৭৬২ সালে নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন হয় বলেই জানা যায়। তবে সেটি ঘটপুজো ছিল। প্রতিমা ছিল না সেই পুজোয়। কথিত, শান্তিপুরের হরিপুর নিবাসী তন্ত্রসাধক চন্দ্রচূড়ের সাধনায় পাওয়া যায় দেবী জগদ্ধাত্রীর রূপের বর্ণনা, এমনকি পূজার মন্ত্র ও মন্ত্রও। রাজা গিরিশচন্দ্র রায় যখন ১৮০২ সালে নদিয়ার রাজত্ব অধিকার করেন, শান্তিপুরের হরিপুরে তখন ১০৮ ঘর ব্রাহ্মণের বাস।

তাঁদের মধ্যে অন্যতম, চন্দ্রচূড়কে রাজা নিজেই অনুরোধ জানিয়েছিলেন রাজসভায় থাকার জন্য। সেই সময়ে ঊষাকালে প্রথম বার জগদ্ধাত্রীর মূর্তি গড়ে পঞ্চমূণ্ডির আসনে কামরাঙা গাছের নীচে পুজো করা হয়েছিল দেবীকে।

জনশ্রুতি অনুযায়ী, তার পর থেকেই কৃষ্ণনগর, চন্দননগর এলাকায় ঊষাবর্ণা, চতুর্ভুজা, সিংহবাহিনী জগদ্ধাত্রী পুজোর সূত্রপাত।

কথিত, নদিয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের আমলে নবাব আলিবর্দি খাঁ, তাঁর কাছ থেকে ১২ লক্ষ টাকা দাবি করেছিলেন দুর্গাজোর আগে। সেই টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে বন্দি করা হয় মুর্শিদাবাদে।

দুর্গা পুজোর বিসর্জনের আবহে কৃষ্ণচন্দ্র ফিরছিলেন কৃষ্ণনগরে। দুর্গা আরাধনা না করতে পারার বিষাদ ঘিরে ধরে। শোনা যায়, সেই রাতেই কৃষ্ণচন্দ্র দেবী জগদ্ধাত্রীর কাছ থেকে স্বপ্নাদেশ পান, তাঁর পুজো করার জন্য।

এই সময়ে শান্তিপুরের ভাগীরথী নদীর উপর দিয়ে ফিরছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র। সন্ধ্যা নেমে আসায় হরিপুর ব্রহ্মশাসনে রাতে থেকে যান তিনি। স্বপ্নাদেশ মেনে সেখানেই চন্দ্রচূড় তর্কাচূড়মণির পঞ্চমুণ্ডির আসনে পুজো করেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র।

কৃষ্ণচন্দ্রের পুজোর অনুপ্রেরণায় ফরাসিদের দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী তৎকালীন ফরাসডাঙা বা এখনকার চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু করেন। সেভাবেই সারা বাংলায় চল হয় জগদ্ধাত্রী পুজোর। শাস্ত্র অনুযায়ী, প্রতিবছর কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে দেবী জগদ্ধাত্রীর আরাধনা করা হয়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...