কাঁধ ঝুঁকিয়ে হাঁটা, চোখ তুলে তাকানো, গলায় বাঁধা সোয়েটার আর ব্যাগি টুপি। ছ-ছটা দশক ধরে তাঁর ক্যারিশমায় মুগ্ধ ছিল বলিউড। বোম্বাই নগরীর প্রথম স্টাইল আই তিনি। পর্দার রোমান্সকে অন্য মাত্রা দিয়েছিলেন। বলিউডের প্রথম ‘কিং অফ রোম্যান্স’ কারও কাছে ‘দেব সাহাব’, কারও কাছে ‘দেব সাব’। এভারগ্রিন দেব আনন্দ।
আসল নাম ধরম দেবদত্ত পিশোরিলাল আনন্দ। জন্ম বর্তমান পাকিস্তানের নরওয়াল জেলা শকরগরে। বাবা পিশোরীলাল আনন্দ ছিলেন পেশায় উকিল। পাঁচ ছেলেমেয়ের মধ্যে ধরম দেবদত্ত তৃতীয়।
ছোটবেলা পুরোটাই কেটেছিল গুরদাসপুরের ঘরোটাতে কাটে। কলেজের পড়া শেষ করে চলে এলেন বোম্বাই। চাকরিও পেয়ে গেলেন মিলিটারি সেন্সর অফিসে। মেরিন ড্রাইভের পাশেই অফিস।
সেই অফিসের পাশেই ছিল এক সিনেমা হল। তখন রমরমিয়ে চলছে ‘অচ্ছুৎ কন্যা’। একদিন দেখতে গেলেন। বুঁদ হয়ে গেলেন অশোককুমারের অভিনয়ে। নেশার মতো টানত লাগল সিনেমা। ফের গেলেন একদিন। এবার ‘কিস্মত’। আবার অশোককুমার।
এবার আর বাঁধ খাটল না। একেবারে ভেসে গেলেন সেনা অফিসের তরুণটি। চাকরি ছেড়ে সোজা থিয়েটারে। সদস্য হলে আইপিটিএ-র। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল স্টুডিয়ো পাড়ায় ঘোরাঘুরি। প্রথম ব্রেক এল ১৯৪৬ সালে। ছবির নাম ‘হাম এক হ্যাঁয়’। তাঁর বিপরীতে নায়িকা কমলা কোটনিস।
ততদিনে বদলে নিয়েছেন নিজের নাম। ধরম দেবদত্ত পিশোরিলাল আনন্দ থেকে রাতারাতি ‘দেব আনন্দ’। নিজের নাম থেকে কেন বাদ দিচ্ছেন ‘ধরম’ সে নিয়ে খুব স্পষ্ট ছিলেন নিজের কাছে।
সেই বছরেই সেনাবিভাগে সেন্সর অফিসের চাকরি ছেড়ে এক দিন সটান হাজির হলেন প্রযোজক বাবুরাম পাইয়ের অফিসে। বাবুরামজী আগত তরুণটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘নাম কী?’
উত্তর এলো, ‘দেব আনন্দ স্যার’।
শুধু ‘দেব আনন্দ?’
তিনি বলেন, ‘আনন্দ আমার পদবি। নামের আগে ধরমও আছে। চারদিকে ধর্ম নিয়ে হানাহানি, তাই ওটা সরিয়ে দিয়েছি। শুধুই দেব আনন্দ।’
সেই থেকে মজে গেলেন সিনেমার প্রেমে। সেই ছবির শুটিং করতে গিয়েই আলাপ হল আরও এক ভাগ্য খুঁজতে আসা তরুণের। ভীষণ বন্ধুত্ব হয়ে গেল দু’জনের। তেমন বন্ধুত্ব গ্ল্যামার দুনিয়ার মানুষরা আর কোনওদিন দেখেনি। দেবের সেই বন্ধুর নাম গুরু দত্ত। ছবির জগতে মাটি খোঁজার জন্য যখন যুদ্ধ চলছে তখন দুজনেই দুজনকে কথা দিয়েছিলেন যে আগে সুযোগ পাবে, সে অন্যকে সাহায্য করবে। সত্যি সত্যি সেই কথা রেখেছিলেন দুই বন্ধু।
দেব আনন্দকে যিনি ভাসিয়ে নিয়ে এসেছিলেন ছবির জীবনে। তিনিই এক দিন আবিষ্কার করলেন নতুন ছেলেটিকে। অন্যরকম চোখ টেনে নেওয়া দেব সুযোগ পেলেন নতুন ছবিতে। ছবির নাম ‘জিদ্দি’। মোড় ঘুরে গেলে দেব আনন্দের জীবনের।
সময়টা পঞ্চাশের দশক। ঠিক তিন বছর আগে দুশো বছরের স্বাধীন হয়েছে দেশ। দাস জীবনের অভ্যাস কাটিয়ে নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে দেশবাসী।। জওহরলাল নেহেরু বার্তা দিয়েছেন ‘ এ দেশ জওয়ানের। এ দেশ কিষানের’। হাজার হাজার ঘর হারা মানুষ রিফিউজি ক্যাম্পে স্যাঁতস্যাঁতে আধাঁরে বসে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল নতুন করে ঘর বাঁধার । যেখানে দুবেলা ভরপেট খাবারের জোগান হবে, মাথার ওপর ছাদ থাকবে, পরনের বস্ত্রের অভাব হবে না। ইংরেজের গোলামী ছেড়ে নিজের দেশের মাটির হারানো ঐশ্বর্য দেশজ সংস্কৃতির শিকড়ে ফিরতে চাইছিল মানুষ।
দেব আনন্দের সমসাময়িক দুই অভিনেতা ছিলেন রাজ কাপুর আর দিলীপ কুমার। দুজনেই তখন পায়ের তলে মাটি পেয়ে গিয়েছেন হিন্দি ছবির দুনিয়ায়। দুজনেই আলাদা ঘরনার। তৈরী করে ফেলেছেন নিজস্ব দর্শক। রাজ কাপুর শ্রী ৪২০ করে মন দখল করে নিয়েছেন দর্শকদের। আর ট্র্যাজেডি, বিষাদে দুর্নিবার দিলীপ। দেব তাহলে খাস কীসে?
শুরু থেকেই দেব ছিলেন অন্যরকম। আদ্যন্ত শহুরে নায়ক। ‘বাজি’, ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’, ‘হাউস নাম্বার ৪৪’এ নজর কেড়েছিলেন। আশ্চর্য সহজ ভঙ্গীতে জীবন দেখতেন পর্দায়। যতই জটিলতা আসুক, সমস্যা কষ্ট আসুক হার মানতেন না। হাসিমুখে বের করতেন সমাধান। জীবনকে সহজভাবে গ্রহণ করার ইতিবাচক এই ভঙ্গী কঠিন বাস্তবকে মোকাবিলা করার সেন পথ বাতলাতো দর্শকদের। সেখানেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন অন্য রকম।
একের পর এক ছবি দিয়ে ইতিহাস গড়েছেন। তাঁর নামের সঙ্গে এবং ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসের সঙ্গে জুড় গিয়েছিল ‘গাইড’ ছবিটি। শুধু ‘গাইড’ নয়, আরও বহু নাম।
নিজের ফোন নিজেই ধরতেন। ফ্যানেদের চিঠির উত্তর দিতেন নিজেই। জীবন নিয়ে ছিলেন সব সময় খোলামেলা। লাহোরের গভঃ কলেজে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন। কলেজের পরিবেশে ছিল পুরোদস্তুর পাশ্চাত্য প্রভাব। তাঁর ওপরও পড়েছিল।
জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ভরপুর থেকেছেন রোমান্সে। এ রোমান্স জীবনের সঙ্গে জীবনের রোমান্স। যা কখনও পুরনো হয় না। সেই ভালোবাসা ঢেলে দিয়েছেন সিনেমার ফ্রেমে-ফ্রেমে। দর্শকরা মুগ্ধ হয়ে থেকেছে দেবের যাদুতে। চাহনিতে, চলায়, গানে, গল্পে তিনি যে চির নতুন! এভারগ্রিন ‘ব্র্যান্ড দেব আনন্দ’!