কালী কথা: দাসীপিসি কালী মন্দির

গঙ্গাপাড়ের জনপদ চুঁচুড়া, হুগলির প্রাচীন এই শহরে প্রথম আর্মেনিয়ানদের পা পড়েছিল। তারপর একে একে আরও অনেক ইউরোপীয় জাতি ভিড় জমিয়েছিল এ শহরে। সে সব ইতিহাস আজও আঁকড়ে রেখেছে 'বন্দেমাতরম'-এর জন্মভূমি চুঁচুড়া। এই চুঁচুড়ার তামলিপাড়ায় রয়েছে মহাসাধক বামাক্ষ্যাপার স্মৃতি বিজড়িত কালী মন্দির। যা দাসীপিসির কালী বাড়ি নামেই খ্যাত। সাধক বামাক্ষ্যাপার জীবনীতে চুঁচুড়ার তামলিপাড়ার সত্যময়ী দেবীর বাড়ির উল্লেখ রয়েছে। সাধক বামাক্ষ্যাপার হাতেই এই কালী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন চুঁচুড়ায়। তখন থেকেই দাসীপিসির কালী পুজো চলছে। সত্যময়ী দেবীর বাড়িতে দুই বার এসেছিলেন বামদেব। বামাক্ষ্যাপা এখানে দেবীর ঘটও প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিলেন। আজও মন্দিরে রয়েছে ঘটটি।

 

সময়টা বাংলার ১২৯৯ সন। পরাধীন ভারতে তখন ব্রিটিশ শাসন চলছে। চুঁচুড়ার তামলিপাড়ার জনৈকা গৃহবধূ সত্যময়ী দেবী মা কালীর স্বপ্নাদেশ পেলেন। স্বপ্নাদেশ পেয়ে তিনি ছুটে গেলেন আবহমান কাল ধরে বয়ে চলা গঙ্গার কাছে। তাঁর বাড়ির অনতিদূর থেকে বয়ে যেত পতিতপাবনী গঙ্গা। স্বপ্নাদেশ মতো গঙ্গাঘাট থেকে তুলে আনলেন এক খণ্ড নিম কাঠ। চুঁচুড়া পেয়ারাবাগানের আর এক ব্যক্তিও ওই একই দিনে দেবী কালীর স্বপ্নাদেশ পান। তিনি সত্যময়ী দেবীর বাড়িতে হাজির হন। স্বপ্নাদেশের কথা জানান। ওই ব্যক্তিকে মা কালী স্বপ্নে বলেছিলেন, তিনি যেন নয় টাকার বিনিময়ে নিম কাঠ দিয়ে মাতৃ প্রতিমা গড়ে দেন। দেবীর নির্দেশ মতো ওই ব্যক্তি নয় টাকার বিনিময়ে ওই নিম কাঠ দিয়ে দক্ষিণা কালীর মূর্তি তৈরি গড়ে দেন। এক আশ্চর্য অলৌকিক শক্তিবলে সূর্যাস্তের আগেই তৈরি হয়ে যায় দেবী মূর্তি।

 

জনশ্রুতি রয়েছে, মায়ের মূর্তি তৈরির পর হঠাৎই একদিন সাধক বামাক্ষ্যাপার নৌকা চুঁচুড়ার তামলিপাড়ার গঙ্গাঘাটে এসে ভেড়ে। গঙ্গাঘাট থেকে পায়ে হেঁটে সত্যময়ী দেবীর বাড়িতে আসেন সাধক বামদেব। সত্যময়ী দেবীর বাড়িতে নিম কাঠ দিয়ে নির্মিত মায়ের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। আজও তামলিপাড়ার সেই বাড়িতে সাধক বামাক্ষ্যাপা প্রতিষ্ঠিত দেবী কালিকার প্রতিমার পুজো হয়। সত্যময়ী দেবীই দাসীপিসি নামে খ্যাত। দেবী কালীর ভক্ত সত্যময়ী দেবী গঙ্গাঘাটে প্রতিদিন স্নান করতেন। স্থানীয় মানুষেরা তাঁকে দাসীপিসি বলে ডাকতেন। পরবর্তীকালে ওই গঙ্গার ঘাটটি দাসীপিসির ঘাট হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। সেই ঘাটেই মাতৃসাধক বামাক্ষ্যাপার নৌকা এসে থেমেছিল।

 

কালী এবং দেবাদিদেব মহাদেবের পবিত্র শিবলিঙ্গ এই মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত। সত্যময়ী দাসী নিঃসন্তান ছিলেন। তাঁর দত্তক পুত্রের বংশধরেরা আজও মায়ের পুজোর দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। প্রতি মাসে অমাবস্যা তিথিতে নিয়ম করে যজ্ঞ ও পুজো হয়। কার্তিক মাসের দীপান্বিতা অমাবস্যায় প্রাচীন রীতি মেনে মায়ের পুজো হয়। শ্যামাপুজোর দিনে বলিদান হয়। পাঁঠাবলির পাশাপাশি চালকুমড়ো বলির প্রথা রয়েছে। কৌশিকী অমাবস্যাতেও মহাধুমধাম করে মায়ের পুজো হয়। 

 

সত্যময়ী দেবী একার ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় গড়ে তুলেছিলেন গঙ্গার ঘাট, মন্দির। মন্দিরের বিরাজ করেন দারু বিগ্রহ। নিম কাঠের তৈরি দক্ষিণা কালী মূর্তি, পদতলে শিব। দেবী চতুর্ভুজা। দেবীর গাত্রবর্ণ অমবস্যার রাতের মতো কালো। এলাকাবাসীর কাছে এই মূর্তি সত্যময়ী কালী নামেও পরিচিত। বংশপরম্পরায় সত্য ময়ীদেবীর পরিবারের সদস্যরাই মন্দিরে পৌরহিত্য করেন। দেবীর কাছে মানসিক করলে, মনোবাঞ্ছা পূরণ হয়। ভক্তরা তা বিশ্বাস করেন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...