তিলোত্তমার সোনালি পালক ১১৭ বছরের ইহুদী বেকারি ‘নাহুম’

নিউ মার্কেটের অন্দরমহল। এফ ব্লকের দিকে পায়ে পায়ে কিছুটা এগোলেই দূর থেকে নাকে উড়ে আসে একটা মিষ্টি গন্ধ। আরও খানিকটা সামনে হাঁটলে ডানদিকে কাচ ঘেরা এক পুরনো দোকান। ভিতরে নজর করলে চোখে পড়বে কেক, পেস্ট্রি, চিজ, কেক। মাথার ওপর সোনা অক্ষরে জ্বলজ্বল করছে একটি নাম। ‘নাহুম অ্যান্ড সন্স প্রাইভেট লিমিটেড।’ এই শহরের সব চেয়ে পুরনো জিউস বেকারি।

সারা বছর ভিড় লেগেই থাকে দোকানে। সকাল  সাড়ে ৯ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত।  শোনা যায় নাহুমের শার্টার খোলার শব্দে আশপাশের মানুষজন তাঁদের ঘড়ি মিলিয়ে নেন। ঝড়-জল-বৃষ্টি- বিপর্যয় কোনওদিন অন্যথা হয় না সে নিয়মের।  

FotoJet - 2019-07-18T203359.336

সময়টা উনিশ শতক। সুদূর বাগদাদ থেকে ভাগ্যের সন্ধানে কলকাতায় এলেন এক যুবক।  নাহুম ইজরায়েল মোরদেকাই। আর পাঁচটা ভাগ্য সন্ধানী যুবকের মতোই অনিশ্চয়তায় ভরা ভবিষ্যৎ। সম্বল বলতে শুধু বাগদাদী খাবারের যাদুবিদ্যা, আর পারিবারিক রেসিপি। সেই নিয়েই কপাল ঠুকে নেমে পড়লেন কলকাতার রাস্তায়।

 হগ সাহেবের বাজারের পাশে একটা ছোট্ট ‘দোকান’ শুরু করলেন। এক চিলতে কনফেকশনারি। সালটা ১৯০২।

সেখানে তৈরি হতে লাগল চিজ, কেক, পাউরুটি, পেস্ট্রি। বাড়ি বাড়ি ফেরি করা হত সেসব খাদ্যবস্তু। অচেনা শহরে অচেনা স্বাদ চেনাতে নাহুম ইজরায়েল অবশ্য চেনা পাড়াকেই বেছে নিয়েছিলেন শুরুতে। সে সময়ে কলকাতা শহরে ইহুদী সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা খুব একটা কম ছিল না। প্রায় চার হাজার ইহুদী বাস করতেন কলকাতায়।

FotoJet - 2019-07-18T203514.854

ধীরে ধীরে ইংরেজরাও নাহুমের স্বাদে মেতে উঠলেন। তারপর আমবাঙালি। পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি আর নাহুম সাহেবকে। বিদেশ বিভূঁই-এর বিপদ, ভয়, আশা-নিরাশার ঢেউগুলো থিতিয়ে এল এক সময়। ক্রমশ কলকাতা শহরটা ভারী আপন হয়ে উঠতে লাগল তাঁর কাছে।কলকাতা শহরে বাগদাদি পাউরুটির চাহিদা বাড়তে লাগল। কিছুটা সাহস পেলেন নাহুম। তাঁর একরত্তি ভান্ডারে নিত্য নতুন খাবারের নাম যুক্ত হতে থাকল।   

FotoJet - 2019-07-18T203619.089

নাহুম ইজরায়েলের পরবর্তী প্রজন্ম ডেভিড, নাহুমের নাতি কনফেশনারির ব্যবসাকে আরও বাড়িয়ে তোলেন।

১৯১৬ সালে নিউ মার্কেটের এফ- ২০ নম্বরে উঠে এল প্রতিষ্ঠান। নাম হল ‘নাহুম অ্যান্ড সন্স প্রাইভেট লিমিটেড’। ১১৭ বছরের পুরনো প্রতিষ্ঠান।

FotoJet - 2019-07-18T203739.049

নতুন শো-রুম তৈরির সময় থেকে কাচ আনা হয়েছিল বেলজিয়াম থেকে। সেকালের নামকরা চিনে মিস্ত্রি কালো সেগুন কাঠ দিয়ে আসবাব তৈরি করেছিল। আজও শো-কেসের পালিশে ঠিকরে ওঠে আভিজাত্যের ঝিলিক। জিঙ্ক প্যানেলের ইতালিয়ান ডেকরেটিভ সিলিং।  

FotoJet - 2019-07-18T203443.264

শতাব্দী পেরিয়ে এখনও সেই ঠিকানা বাঙালির অবশ্যম্ভাবী গন্তব্য। ২০১৩ সালে প্রয়াত হন ডেভিড নাহুম। কিন্তু বদলায়নি নাহুমি মায়া। ঝরা সময়ের পালক সযত্নে আগলে রেখেছে নাহুমের কর্মচারীরা।  

ট্র্যাডিশন বদলায়নি নাহুম। চিজকেক, পেস্ট্রি, প্যাটিসের স্বাদ আজও একইরকম। এতগুলো বছরে এতটুকু বদল হয়নি সে স্বাদে। বদল হয়নি প্যাকেজিং-এও। ঝকঝকে প্যাকেজিং এর যুগে নাহুম এখনও কাগজের বক্সে। নাহুমের ‘ফ্রুট কেক’ পৃথিবী বিখ্যাত।

FotoJet - 2019-07-18T203708.929  

নাহুমের কোনও দ্বিতীয় শাখা নেই। রবীন্দ্রনাথ থেকে সত্যজিৎ রায় সহ বহু বিখ্যাত মানুষ নাহুমের ফ্যান ছিলেন।

কলকাতার কনফেকশনারির ইতিহাসে ‘নাহুম’ চিরকাল ‘আইকনিক’ ফিগার। জিউস কলকাতার সাঁঝবাতি হয়ে আজও সে আলো দিচ্ছে তিলোত্তমা শহরে।  

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...