উত্তম কুমারের 'ছদ্মবেশী' ও অনেক ছবিতেই প্রথম অভিনয় করেছিলেন নায়ক ছবি বিশ্বাস

ডাক নামে যাঁদের নামডাক হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ও বিশিষ্টতম হলেন ছবি বিশ্বাস। পোশাকি নাম, শচীনন্দ্রনাথ বিশ্বাস। বাবা ভূপতিনাথ। তাঁর সঙ্গে মিলিয়ে ছেলের নামেও যুক্ত হয়েছিল 'নাথ'। ডাক নামটি দেওয়ার ভার পেয়েছিলেন মা, অথবা, নিজেই সে ভার হাতে তুলে নিয়েছিলেন--গোলগাল পটের ছবিটির মতো আঁকা যাঁর চোখনাকমুখ, স্বাভাবিকভাবেই সেই ছেলের নাম দিয়েছিলেন, 'ছবি'। শিল্পের দুনিয়ায় মায়ের দেওয়া সেই ডাক নামই একদিন জগৎজোড়া খ্যাতি পেল, তাতেই হল নামডাক।

 

বিডন স্ট্রিটের বিশ্বাস পরিবার হল, যাকে বলে, রীতিমতো বনেদি পরিবার। কাজেই ছবি জন্মেছিলেন সোনার চামচ মুখে দিয়ে। আর সেকালে বনেদি পরিবার মানেই একান্নবর্তী, বনেদি পরিবার মানেই জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে বনেদিয়ানায় এবং সংস্কৃতিচর্চায় হয় টক্কর, নয় অনুসার। ফলে, বাড়িতে গানবাজনা ও অভিনয়ের আসর নিয়মিত বসত। বিডন স্ট্রিট ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলে সেকালে নাট্যচর্চার যে দখিনা বাতাস বইছিল, তা ছবিকেও আমূল ছুঁয়েছিল। সুতরাং, বাল্যকাল থেকেই ছবি হয়ে উঠলেন নাটকের পোকা, অভিনয়ের ন্যাওটা। ঘরোয়া নাটকে ভাইবোনদের সঙ্গে তিনিও হয়ে উঠলেন মঞ্চের বাঁধা অভিনেতা।

 

বিদ্যাসাগর কলেজে পড়ার সময় তিনি একবার শিশিরকুমার ভাদুড়ী'র সঙ্গে নাটকে অভিনয়ের সুযোগ পেলেন। দেখলেন নাট্যাচার্যের নাট্যাভিনয়ের ঐশ্বর্য। আকৃষ্ট হলেন। অভিনয়কে আরও আঁকড়ে ধরলেন। সিকদার বাগানের 'বান্ধব সমাজ' নাট্যদলে যোগ দিলেন; 'নিমাই সন্ন্যাস'-পালায় নিমাই চরিত্রটিতে এমন প্রাণপ্রতিষ্ঠা করলেন যে, চারিদিকে ধন্য ধন্য পড়ে গেল!

 

না, নাটকের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে তাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার কথা তিনি তখনও ভাবলেন না। এদিকে বনেদিবাড়ির ছেলে হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াবেন না--এমন শিক্ষাও তিনি পাননি--তাই প্রথমে বিমা কোম্পানিতে যোগ দিলেন। কিন্তু, জীবনমৃত্যুর হিসেব কষতে ভালো লাগল না। ধরলেন পাটের ব্যবসা। শিল্পী মানুষের কী আর ব্যবসায় সুবিধে হয়! রামপ্রসাদ হিসেবের খাতায় গান লিখেছিলেন, হিসেব লিখতে পারেননি। তাই শেষমেশ সেই প্রানের ধন অভিনয়ের কাছেই ফিরতে হল ছবিকে; যোগ দিলেন পেশাদার রঙ্গমঞ্চে। অভিনয় করলেন, 'সমাজ' নাটক। দারুণ সাফল্যের সঙ্গে একের পর এক শো চলতে লাগল, একের পর এক নাটকে চলতে লাগল অভিনয়। তখন অধিকাংশ সিনেমার পরিচালক--নিজেরা যেমন থিয়েটার ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে উঠে আসতেন, তেমনি সিনেমার জন্য নতুন প্রতিভাবান অভিনেতা-অভিনেত্রীর সন্ধানও তাঁরা থিয়েটারেই করতেন। তাই তাঁরা নিয়মিত থিয়েটার দেখতেন। এভাবেই একদিন সেই সময়ের বিখ্যাত প্রযোজনা সংস্থা 'কালী ফিল্মস'-এর প্রযোজক প্রিয়নাথ গঙ্গোপাধ্যায় এবং পরিচালক তিনকড়ি চক্রবর্তী'র চোখে পড়ে গেলেন ছবি বিশ্বাস। তাঁরা নিরুপমা দেবীর জনপ্রিয় উপন্যাস 'অন্নপূর্ণার মন্দির'-এর কাহিনি নিয়ে ওই একই নামে ছবি করবেন। তাই নায়ক খুঁজছিলেন। দীঘলদেহী, সুন্দর-সুঠাম ও সুঅভিনেতা ছবিকে দেখে তাঁদের ভারি পছন্দ হল। ডাকিয়ে স্ক্রিন টেস্ট নিলেন। ছবি তাতে উৎরেও গেলেন। ব্যস, ছবি হয়ে গেল। মুক্তি পেল ১৯৩৬ সালের ১৩ জুন। 'উত্তরা' সিনেমায়। সারা বাংলা জানল এমন একজন নতুন হিরো বাংলা ছবিতে এসেছেন, যাঁর নামটি মেয়েলি হলেও অভিনয় অসম্ভব আভিজাত্যপূর্ণ ও নায়কোচিত। ছবি রমরমিয়ে চলল, নায়ক ছবি সফল হলেন। নায়ক হিসেবে তিনি অনেকগুলো ছবিতে অভিনয় করেছেন। তার মধ্যে তাঁর অভিনীত 'অন্নপূর্ণার মন্দির', 'ছদ্মবেশী', 'দুই পুরুষ', 'বিরাজ বউ'--প্রভৃতি ছবিগুলো পরবর্তীকালে উত্তম কুমারকে নায়ক করে রিমেক করা হয়েছিল। পাঁচ বছরের প্রথাগত নায়কজীবন পেরিয়ে ১৯৪১ সালে প্রথম তিনি চরিত্রাভিনেতার ভূমিকায় সরে এলেন। নিউ থিয়েটার্স-এর 'নর্তকী' ছবিতে নব্বই বছরের বৃদ্ধ স্বামীজীর ভূমিকায় অভিনয়ের মধ্য দিয়ে। এই চরিত্রাভিনেতা পর্বই হল তাঁর অভিনয়ের পরশ পাথর পর্ব। ছবিতে সেই পাথরের স্পর্শ দেওয়ার জন্য সত্যজিৎ রায়, অজয় কর, বিজয় বসু, অগ্রগামী, অগ্রদূতের মতো সমস্ত ধারার বিখ্যাত পরিচালকেরা সমানভাবে ব্যগ্র ছিলেন। তাঁকে ভেবে, তাঁর ব্যক্তিত্বের কথা মাথায় রেখে এঁরা কাহিনি-চিত্রে চরিত্র নির্মাণ করতেন। চরিত্রাভিনেতা হয়েও মৃত্যুর ষাট বছর পর তিনি আজও সমান প্রাসঙ্গিক। তাঁর শূন্য আসন এখনো পূর্ণ হয়নি। তাঁর তুলনা একমাত্র তিনিই। একজন প্রকৃত ও শক্তিশালী অভিনেতার এর চেয়ে বড় এচিভমেন্ট আর কীই বা হতে পারে!

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...