বঙ্গের শীতলা আরাধনার আড়াই শতক: বড়মা শীতলা ও দুর্গা রুপী শীতলা মন্দির

বসন্তকালে শীতলার আরাধনায় মাতে বাংলা। প্রচলিত বিশ্বাস মতে, শীতলা দেবীর পুজো করলে গুটিবসন্তের প্রকোপ এড়ানো যায়। স্কন্দপুরাণ এবং ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণেও এমনটাই বলা হয়েছে। দেবী শীতলা বসন্তের দেবী হিসেবে পরিচিত হলেও কালক্রমে, কলেরা থেকে প্লেগ এবং যেকোন মহামারীর ক্ষেত্রেই শীতলা দেবী হয়ে উঠেছেন রক্ষাকর্ত্রী। মানুষ দেবীর শরণাপন্ন হয়েছেন, রক্ষা পেয়েছেন। পৌরাণিক ইতিহাস বলে, যজ্ঞের আগুন থেকে শীতলা দেবীর জন্ম। স্বয়ং ব্রহ্মাও দেবীকে সমীহ করেন। মহামারী থেকে বাঁচতে শীতলার পুজো করে চলেছে বাংলা। বাংলা ছাড়াও উত্তর ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে শীতলা পুজো করা হয়। পুজোর দিন মা শীতলাকে বাসি অর্থাৎ আগের দিনের খাবার ভোগ হিসেবে নিবেদন করা হয়। তাঁর ভক্তরাও বাসি খাবার খেয়ে থাকেন, যা শীতল পান্তা হিসেবে পরিচিত। শীতলাকে স্বাস্থ্যের দেবী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। মনে করা হয়, শীতলা পুজোর দিন উপবাস করে পুজো করলে, ভক্তর বাড়িতে অর্থ ও খাবারের অভাব হয় না। ভক্তর পরিবার ও সন্তান সুস্থ থাকেন। গ্রাম বাংলায় বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলে বলা হয়, 'মায়ের দয়া' হয়েছে। মনে করা হয়, মায়ের কৃপা।

এক কাহিনী অনুসারে, শিবের পরম ভক্ত বিরাট রাজা শীতলাকে ভক্তি করতেন না, এই কারণে শীতলা তাঁর রাজ্যে নানা রোগব্যাধির প্রকোপ বাড়িয়ে দেন। রাজা শেষ পর্যন্ত নতিস্বীকার করতে বাধ্য হন। তিনি শীতলার করুণা ভিক্ষা দেবী প্রসন্ন হন, ফলে বিরাটরাজ্য রোগমুক্ত হয়। আবার অন্য এক পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, একদা জ্বরাসুর নামে এক অসুর গোটা পৃথিবীতে দুরারোগ্য রোগ ছড়াচ্ছিল। কলেরা, হাম ও গুটিবসন্ত চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। সে যেখানেই যেত, সেখানকার বাচ্চাদের মধ্যে জ্বরের প্রকোপ দেখা দিত। জ্বরাসুরের কারণে যখন আতঙ্ক ছড়িয়ে, তখন শিব ও পার্বতী জ্বরাসুরকে দমন করতে আবির্ভূত হন। মহাদেব ভৈরব রূপ ধারণ করে জ্বরাসুরের সঙ্গে যুদ্ধে করেন। অন্যদিকে, পার্বতী দেবী শীতলার রূপ নিয়ে মর্ত্যলোক শীতল করতে নেমে আসেন। নিজের হাতের পাত্র থেকে দেবী সর্বত্র শীতল জল ছড়িয়ে দেন এবং ঝাড়ু দিয়ে রোগ বহনকারী জীবাণু দূরে সরিয়ে দেন, রোগ মুক্তি ঘটান। পৌরাণিক ইতিহাস বলে, পার্বতী ঋষি কাত্যায়নের কন্যারূপে মর্তে অবতীর্ণ হন। বাবা কাত্যায়ন নিজের নাম অনুসারে তার নাম রাখেন কাত্যায়নী। শৈশব অবস্থা থেকেই কাত্যায়নী রোগ নিরাময় করতে শুরু করেন। এক সময় জ্বরাসুর তা জানতে পারে ও রেগে গিয়ে রোগের প্রকোপ আরও বাড়াতে থাকে। জ্বরাসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাকে পরাস্ত করতে শিবকে অনুরোধ করেন কাত্যায়নী। শিব বটুক নামক এক যুবকের বেশে মর্ত্যে অবতীর্ণ হন। শুরু হয় বটুক ও জ্বরাসুরের মধ্যে যুদ্ধ এবং শেষে বটুক ত্রিশূল দিয়ে আঘাত করে জ্বরাসুরকে নিষ্ক্রিয় করে দেন। এই কাত্যায়নীই শীতলা নামে মানুষের রোগব্যাধি সারাতে থাকেন। পুরাণ অনুসারে, শীতলা আদ্যাশক্তি দেবী দুর্গারই একটি রূপ। দেবী দুর্গার অবতার রূপে তিনি পক্স, ঘা, ব্রণ, ফুসকুড়ি ইত্যাদি রোগ নিরাময় করেন এবং ভূতের হাত থেকেও রক্ষা করেন। কোথাও কোথাও শীতলাকে দ্রোণাচার্যের স্ত্রী বলে মনে করা হয়। কোনও কোনও জায়গায় তিনি 'শীতল' নামেও পরিচিত। বৌদ্ধের কাছে তিনি হারিট, বৌদ্ধ ধর্মে তাঁকে রোগব্যাধির প্রধান দেবী পর্ণ-শর্বরীর সঙ্গী হিসেবে পুজো করা হয়। চিনে তিনি উষা। মুসলমানদের কাছে তিনিই বুড়াবুবু। 

বসন্তের হাত থেকে বাঁচার জন্য দেবী শীতলার পুজো করে, তাঁকে তুষ্ট করা গ্রামীণ সমাজের বহু প্রাচীন এক রীতি। শীতলা দেবীর বাহন গাধা। দেবী ত্রিনয়নী, গাত্রবর্ণ ফর্সা, পরনে নীল রঙের পোশাক ও চার হাত। চার হাতে যথাক্রমে একটি বাটি, পাখা, ঝাড়ু ও শীতল জলের পাত্র। ঝাড়ু জীবাণু ও ধূলিকণা পরিষ্কার করার জন্য এবং শীতল জল রোগ নিরাময়ের প্রতীক। বাংলায় দেবী পুজো হয় বসন্তকালে, ফাল্গ‌ুন মাসে। দোলযাত্রার পর অষ্টম দিনে শীতলা অষ্টমী আসে। এই সময়টায় মহামারীর প্রকোপ বাড়ে। শীতলার সঙ্গে এই সময় পুজো পান কলেরার দেবী ওলাদেবী, চর্মরোগের অধিষ্ঠাত্রী ঘেঁটু এবং রক্তের সংক্রমণজনিত রোগের সঙ্গে জড়িত রক্তদেবী। 

শীতলা অর্থে যে দেবী সবকিছু শীতল রাখেন। হাওড়া সালকিয়া অঞ্চলে পূজিতা হন ঠাকুর বড় শীতল মা। ভক্তরা তাদের মনোবাঞ্ছা নিয়ে আসেন বড় শীতলা মার কাছে, তিনি বড়মা নামে পরিচিত। সকলের বিশ্বাস, বড়মার কাছে যা চান, তাই পান। প্রতি বছর মাঘীপূর্ণিমার দিন সালকিয়া জুড়ে আয়োজন করা হয় বিশাল শোভাযাত্রার। সালকিয়ার প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল প্রদক্ষিণ করানো হয় বড়মাকে। সঙ্গে থাকেন মায়ের ছোট বোনেরা। আদপে এটি বড়মার স্নানযাত্রার অনুষ্ঠান। রাজ্য জুড়ে নানান প্রান্ত থেকে এদিন ভক্তরা আসেন। পালকিতে থাকেন মা, পুরো সালকিয়া ভ্রমণ করেন মা। হাওড়া শহরে মাঘী পূর্ণিমা মানেই বড় মায়ের স্নান যাত্রা। ভক্তদের বিশ্বাস, হাওড়ার বড় মা তাঁদেরকে বহু বছর ধরে বসন্ত রোগের হাত থেকে রক্ষা করে আসছেন। আড়াইশ বছর ধরে চলে আসছে এই রীতি। মাঘ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে শীতলা মা স্নান করে যখন বাড়িতে ফেরেন। তারপর মায়ের অভিষেক করানো হয়। তারপর শুরু হয় ষোলআনা পুজো প্রস্তুতি। ভোর থেকে পুজো নেওয়া শুরু হয়।

লৌকিক মতে এখানকার শীতলা দেবীরা সাত বোন। এঁদের মধ্যে হরগঞ্জ বাজার এলাকায় পাশে অরবিন্দ রোডের মন্দিরে রয়েছেন শীতলা দেবীর বড় বোন। যা 'বড়মার মন্দির' নামে খ্যাত। সাত বোনের কোনওটির মূর্তি দারু নির্মিত, কেউ হাঁড়িতে আঁকা। একমাত্র কয়েল বাগানের কয়েলেশ্বরী মা শীতলার মূর্তিটি পাথরের। বড় মায়েরা আসলে শীতলা দেবী। ভক্তদের বিশ্বাস, বসন্তে দেবী নিজে গঙ্গায় স্নান করে নিজে যেমন শীতল হন তেমনই পৃথিবীর মাটিকেও শীতল বা ঠাণ্ডা করেন। তাই শীতলা পূজার সঙ্গে বৎসরান্তে স্নান যাত্রার একটি পর্ব রয়েছে। এই স্নান যাত্রার প্রচলন সম্ভবত সালকিয়া অঞ্চলেই সিমাবদ্ধ। বড় মা ও তার সব বোনেরা মিলে গঙ্গাস্নানে বের হন। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে সালকিয়া অঞ্চলে মেলা বসে ও শীতলা মায়েদের স্নান শেষে এলাকায় ভোগ বিতরণ হয়। অনেকেই সম্পূর্ণ উপবাস করে মায়ের স্নান শেষে রাতে পুজো দিয়ে ফল মিষ্টি খান। উৎসবের দিনে উপবাসীরা নতুন জামা কাপড় আর গামছা পরে মায়েদের বাঁশের পালকি বা চতুর্দোলায় কাঁধ দেন,অনেকে গঙ্গাঘাট অর্থাৎ বাঁধাঘাট থেকে বড়মার মন্দির পর্যন্ত দণ্ডী কাটেন। পরের দিন ষোলো আনার পুজো দিয়ে ব্রত সম্পূর্ণ করেন। আগে সাত জন মা আসতেন স্নান করতে। বর্তমানে সংখ্যাটা আশিরও অধিক। প্রায় আড়াইশো বছরের রীতি, প্রতি বছর মাঘী পূর্ণিমায় শীতলা উৎসবে বড় মা পাল্কি করে গঙ্গাস্নানে যান। এরপর ফের তাঁকে শালকিয়ার অরবিন্দ রোডের মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করা হয়। একই পথের অনুসারী মেজ মা, সেজ মা, ছোট মায়েরা। 

হাওড়ার মতো শ্রীরামপুরের চাতরায় দুশো বছর ধরে চলছে শীতলার আরাধনা। মায়ের পুজো উপলক্ষ্যে মেলাও বসে। গোটা বাংলা থেকে মানুষজন এখানে আসেন। ঐতিহাসিকরা বলেন, বাংলা ১২৬০ সন থেকে এখানে শীতলা দেবীর আরাধনা শুরু হয়েছিল। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আজও পুজো হয়ে আসছে। শুধু শ্রীরামপুর বা হুগলী জেলা নয়, বাংলার বিভিন্ন জায়গা, হাওড়া, উত্তর চব্বিশ পরগনা, নদিয়া, বর্ধমান থেকে কাতারে কাতারে মানুষ এ সময় চাতরায় পুজো দিতে আসেন। চাতরায় শীতলা মায়ের পুজো নিয়ে কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছে। শোনা যায়, একদা চাতরায় বসন্ত রোগের প্রকোপ দেখা দিয়েছিল। সে'সময় মহামারীর আকার ধারণ করে বসন্ত। পরিত্রাণ পেতে সাধক রাম দাস মা শীতলার পুজো শুরু করেন। জনশ্রুতি অনুযায়ী, মহামারি ঠেকাতে স্বপ্নাদেশ পেয়ে তিনি শীতলা পুজোর প্রচলন করেন। তারপর দেবী শীতলা সন্তুষ্ট হতেই, চাতরা মহামারীর কবল থেকে রক্ষা পায়।

ফাল্গুন মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতে এখানে পুজো হয়। বাংলার অনেক জায়গায় কেবল এই অষ্টমীর দিনেই শীতলা পুজো হয়। অষ্টমীর দিনে দেবীকে নিবেদন করা হয়, ঘিয়ে ভাজা লুচি, বিনা তেল-হলুদের, ঘি-শুকনো লঙ্কা ফোড়নের আলুর তরকারি। তরকারির স্বাদ অমৃতের সমান। যারা ভোগ পান তারা বলেন, এই স্বাদের তুলনা হয় না।সপ্তমীতে রাত জেগে অষ্টমী তিথিতে মন্দিরে জল ঢালেন হাজার হাজার মানুষ। স্থানীয়রা বলেন, শীতলা মায়ের পুজো তাদের কাছে দুর্গা পুজোর মতো। দেবী দুর্গার আদলে শীতলা মায়ের মুখের গড়ন, টানা টানা চোখ। হলুদ বর্ণ। সখীরা মায়ের চারপাশে। সোনার গয়নায় মাকে সাজানো হয়। শতাব্দী প্রাচীন শীতলা মায়ের পুজোকে ঘিরে কয়েক দিন মেতে ওঠে শ্রীরামপুর চাতরা। এলাকা জুড়ে বিরাট মেলা বসে। 

শ্রীরামপুরের চাতরা নিবাসীদের কাছে শীতলা মায়ের পুজো দুর্গা পুজোর সমতুল্য। ফি বছর ফাল্গুন-চৈত্র মাসে তিথি মেনে পাঁচ দিন ধরে চলে শীতলা মায়ের আরাধনা চলে। মূল পুজো হয় অষ্টমীতে। ভক্তরা সকাল থেকে উপোস করে মায়ের বেদিতে জল ঢেলে পুজো দিয়ে ব্রত ভাঙেন। অনেকে দন্ডিও কাটেন। মন্দিরের সামনে থেকে পুজো দেওয়ার জন্য ভক্তদের লম্বা লাইন পড়ে যায়। চাতরার এই শীতলা মায়ের মুখ, সাবেকি দুর্গার আদলে নির্মিত। দশমী পুজোর পরে মায়ের বিসর্জন হয়। ডাবের উপরে সিঁদুর লেপে রুপোর চোখ বসিয়ে সারা বছর মায়ের মন্দিরে পুজো হয়। মন্দির ট্রাস্টি বোর্ড সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রায় ২০০ বছরের বেশি সময় ধরে এখানে শীতলামায়ের পুজো হচ্ছে। পুজোর এক সপ্তাহ আগে থেকেই গোটা চাতরা এবং আশেপাশের বাসিন্দারা নিরামিষ খাবার খান। দুর্গাপুজোর মতো তিথি-নক্ষত্র মেনে ষষ্ঠী থেকে মায়ের পুজো শুরু হয়, তা দশমী পর্যন্ত চলে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...