বিরিয়ানির বনেদিয়ানা

বিরিয়ানি পছন্দ করে না, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া হয়ত দায়। আজ এই বিরিয়ানির জন্ম বৃত্তান্ত নিয়ে কিছু কথা বলব, বাঙালির প্রিয় কলকাতা বিরিয়ানি হল; যাকে বলে আলু বিরিয়ানি নিতান্ত আর্থিক দুরাবস্থায় কার্যত বাধ্য হয়েই ওয়াজিদ আলী শাহ বিরিয়ানিতে আলু দেওয়ার ব্যবস্থা করেন, তখন তিনি আর লক্ষ্ণৌ-এর গোমতীর তীরের নবাব নন! তাঁর নিজের তৈরি কলকাতার লক্ষ্ণৌ অর্থাৎ মেটিয়াবুরুজ গার্ডেনরিচ চত্বরের বেতাজ নবাব।

খাবারের জগতের এই সুপারস্টারের জন্ম কোথায়? কীভাবে? খাবারটি উপমহাদেশে বিপুল জনপ্রিয়। ইতিহাসবিদরা মনে করেন করেন, খাবারটি উপমহাদেশের বাইরে থেকে এসেছে। সবারই নজর আফগানিস্তান, ইরান ও অন্যান্য আরব এলাকার দিকে।

*ব্যারাকে জন্ম বিরিয়ানির:*

মোগল সম্রাট শাহজাহানের স্ত্রী মমতাজ মহলের শখ হল ব্যারাকে যাবেন। মোগল সেনাদের দেখতে চান তিনি। গিয়ে তিনি অবাক হলেন।  মোগল সেনারা দুর্বল আর অপুষ্টিতে ভুগছে। বাবুর্চিকে ডাক দিলেন মমতাজ। নির্দেশ দিলেন চালের সঙ্গে মাংস মিশিয়ে রান্না করার জন্য। সঙ্গে যেন ঘিও থাকে। ঘিয়ে ভাজা হল চাল। মেশানো হল মাংস। ওই স্বাদ কেবল সেনাদের মুখেই লাগল তা না, পৌঁছাল মোগল দরবার পর্যন্ত।

বিরিয়ানির জন্ম প্রসঙ্গে ইতিহাসবিদদের একটি দল মোগলদের পক্ষে। তাঁদের কয়েকটা যুক্তির মধ্যে মমতাজের ওই কাহিনী একটি।

সেনাদের নিয়েই প্রচলিত আছে বিরিয়ানির আরেকটি কাহিনী। তুর্ক-মোঙ্গল শাসক তৈমুর লং মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা দখলে নিয়ে নেন। আর তার অন্যতম একটা পথ ছিল ভারত। ১৩৯৮ এর দিকে তৈমুরের নাগালে চলে আসে ভারতের কিছু অংশও। এ এলাকায় সেনাদের খাবার কী হবে? সেনাদের তো হৃষ্টপুষ্ট রাখা চাই। চালের সঙ্গে মিশল মাংস আর মশলা। বিরিয়ানির স্বাদে তৈমুরের বাহিনী  মুগ্ধ!

দক্ষিণ ভারতে যে কাহিনীটা প্রচলিত তার সঙ্গেও সেনারা জড়িত। তামিল সাহিত্যে 'ওন সরু' নামে একটা খাবারের কথা আছে। খ্রিস্টপূর্ব দুই হাজার বছর আগে ওন সরুর নাম পাওয়া যায়। বলা হয়, তখন যোদ্ধাদের স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য চালের সঙ্গে মাংস, ঘি, হলুদ, বেশ কিছু মেশানো হয় এবং তৈরি হয় ওন সরু। ওন সরুই কি বিরিয়ানির আদি রূপ কি না,সেই গবেষণা চলছে। দক্ষিণ ভারতে বিরিয়ানি আনার জন্য আরব ব্যবসায়ীদের  কৃতিত্ব রয়েছে, মালাবার উপকূলীয় এলাকা দিয়ে আরবরা আসত ব্যবসার জন্য। তারাই সাথে নিয়ে আসে ওই খাবার।

বিরিয়ানির উৎস খুঁজতে গিয়ে আবার ইতিহাসবিদদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন ভাষাবিদরাও। এদেরই একদল বলছে, বিরিয়ানি শব্দটা এসেছে পার্সি শব্দ 'বিরিয়ান' থেকে। যার অর্থ রান্নার আগে ভেজে নেওয়া। আর পার্সি শব্দ ব্রিনিজ মানে হচ্ছে চাল। এদের দাবি বিরিয়ানিটা পশ্চিম এশিয়া থেকেই যায় ভারতে।

বিরিয়ানির কথা হবে আর হায়দরাবাদের কথা আসবে না, তা কি হয়। চলে আসে লখনৌর নামও। হায়দরাবাদের নিজাম আর লখনৌর নবাবদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় বিরিয়ানি। এই দুই অঞ্চলেই হয় বিরিয়ানি  ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র।রসগোল্লার পরে এবার বিরিয়ানি নিয়ে গোল বেঁধেছে দক্ষিণ ভারতের দুই রাজ্যে, হায়দ্রাবাদ শহরের বিরিয়ানি পৃথিবী বিখ্যাত হয়েছে আগেই।একসময়ে অন্ধ্র প্রদেশের রাজধানী ছিল হায়দ্রাবাদ শহর। কিন্তু  অন্ধ্র ভেঙ্গে এখন তৈরি হয়েছে নতুন রাজ্য তেলেঙ্গানা।রাজধানী হায়দ্রাবাদ পড়েছে তেলেঙ্গানার ভাগ্যে। অন্ধ্র সরকারের সব দপ্তরই চলে গেছে, তাদের নতুন তৈরি হওয়া রাজধানী শহর অমরাবতীতে।

পুরনো রাজধানী শহরের  সঙ্গেই, তারা হারাতে বসেছে হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানির ব্র্যান্ড ভ্যালুও।তাই অন্ধ্র চেষ্টা করছে নিজস্ব বিরিয়ানি ব্র্যান্ড তৈরি করতে। খুঁজেও পেয়েছে তারা নিজস্ব এক  বিরিয়ানি। এর নাম 'বঙ্গু বিরিয়ানি'। আরাকু উপত্যকার আদিবাসীদের রন্ধনপ্রণালী থেকে এসেছে এই বঙ্গু বিরিয়ানি।এই নামের রহস্য হল বঙ্গু বা বাঁশের খোলে দমে রান্না করা হয় এই বিরিয়ানি। মোটা বাঁশের খোলে রান্না হয় এই বিরিয়ানি, যা হায়দ্রাবাদী, লক্ষ্ণৌ, কলকাতা বিরিয়ানি, কেরালার বিরিয়ানি রান্নার থেকে একেবারে আলাদা পদ্ধতি। তবে গ্রাম থেকে শহর, মফস্বল থেকে মহানগর অলিগলির মোড়ে মোড়ে লাল শালুতে মোড়া বড় বড় হাঁড়ির দর্শন আর তা থেকে নির্গত সুবাসেই তৃপ্ত হয় খাদ্যরসিক বাঙালির মন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...