১৯৪০ থেকে ১৯৪২ সাল, বাংলার রাজনৈতিক জীবনে শুরু হয়ে গেছে নিয়মিত পরিবর্তন। জাতির জীবনে নেমে এসেছে নিদারুণ বিপর্যয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা বিপর্যস্ত করে তুলেছিল মানুষের দৈনন্দিন স্বাচ্ছন্দ্যকে এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত হতে শুরু করেছিল সমগ্র বিশ্বে। বাংলার জীবন-চেতনা ঘেঁটে গিয়েছে মন্বন্তর,মড়ক, কালোবাজারি, অনাহার, হানাহানি, মৃত্যু –এসবের ভয়াবহ স্থিতিতে। সেইসব সময় এক বিদগ্ধ-হৃদয়, মাটিতে রাখা জলচৌকির উপর ঝুঁকে পড়ে চোখের জলে কুঁকড়ে-ফুলে যাওয়া পাতায় খস খস কলম চালিয়েছেন, থামেন নি। অন্তরাত্মা নিংড়ে লিখেছেন- ‘নবান্ন’, ‘জবানবন্দী’, ‘দেবীগর্জন’, ‘মরা চাঁদ’, ‘আগুন’, ’জীয়ন কন্যা’, ’লাস ঘ্যুইরা যাউক’।
১৯০৬-এর ১৭ই জুলাই, ফরিদপুর জেলার খানখানাপুরে জন্ম নেন স্কুলশিক্ষক ক্ষীরোদবিহারী ভট্টাচার্য ও সুবর্ণপ্রভা দেবীর সন্তান, বিজন। বিজন ভট্টাচার্য। জন্মের পর তাঁর বেড়ে ওঠার সাথে সাথে বেড়ে উঠতে থাকে শিকড়ের প্রতি মমত্ববোধ, দেশভাগের অপূরনীয় মর্মযন্ত্রনা। ছাত্রাবস্থাতেই যুক্ত হন স্বদেশি আন্দোলনে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হওয়ার পর তাঁর মাতুল প্রখ্যাত সাংবাদিক সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার কর্তৃক অরণি পত্রিকা প্রকাশিত হলে শুরু হয় সেখানে তাঁর গল্প লেখা। একইসময়ে খ্যাতিমান মার্কসবাদী রেবতী বর্মণের লেখা পড়ে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি তিনি আকৃষ্ট হন। ১৯৪২-৪৩ সালে সদস্যপদ লাভ করেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির। ১৯৪৪ সালে আনন্দবাজারের চাকরি ছেড়ে পার্টির হোলটাইমার হন।
.jpg?1563364056790)
জনচেতনা পুনরূদ্ধারের উদ্দেশ্যে নাটকের চলিত ভাষা পাল্টে ফেলার প্রবল উদ্যোমে একদল উৎসাহী যুবক সংঘবদ্ধ ভাবে প্রকাশ্যে এনেছিল নবনাট্য আন্দোলন। বিজন ছিলেন একই সঙ্গে গণনাট্য ও নবনাট্য আন্দোলনের পুরোধা। ভারতীয় গণনাটকের প্রথম স্রষ্টা বিজন ভট্টাচার্য রচিত ‘নবান্ন’ নাটকটি দেখে ইংরেজ সৈনিকদের অন্যতম বৈমানিক বিল বাটলার উদ্বুদ্ধ হয়ে একটি আবেগঘন চিঠি লিখেছিলেন তাঁকে। শুধু বিলের চিঠিই নয়, এদেশে ঘটে যাওয়া ভয়াবহতম দুর্ভিক্ষ সম্বন্ধে ব্রিটিশ সরকারের নীরবতায় ক্ষুব্ধ হয়ে সে দেশের গণতন্ত্রপ্রিয় মানবতাবাদী নাগরিকদের বিভিন্ন সংবাদপত্রে তাঁর একের পর এক লেখায় প্রকাশ পেতে থাকে পরিস্থিতির নির্মমতার কথা এবং তারই ফলে সৃষ্ট ব্যাপক জনমতের চাপে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইন্স্টন চার্চিল বাধ্য হন ১৯৪৪-এর ‘দুর্ভিক্ষ তদন্ত কমিশন’ গঠন করতে। এমনই ছিলেন তিনি তেজী।
.jpg?1563364089534)
পৃথিবীর ইতিহাসে কোনও নাটকের মাধ্যমে সামাজিক বিপর্যয়ের পিছনে ক্ষমতাসীন সরকারের মুখোশ উন্মোচন করার এ ছাড়া দ্বিতীয় নজির মেলে না। বিজন ভট্টাচার্য রচিত ‘নবান্ন’ নাটক সেই অর্থে পৃথিবীর নাট্য ইতিহাসে বিরলতম এক উদ্ভাস। ঐতিহাসিকভাবে আলোড়ন ফেলে দেওয়া এমন একটি নাটক কিভাবে বাংলা তথা ভারতীয় নাট্যমণ্ডলের আমূল দিকবদল ঘটিয়ে দিয়েছিল, সে স্বীকৃতি পাওয়া যায় খ্যাতনামা নাট্যব্যক্তিত্ব উৎপল দত্তের কথায়। তিনি বলছেন—
“অমরেন্দ্রনাথের মঞ্চসজ্জা ব্যবসায়িক চটোকে পরিণত হয়ে পরবর্তীকালে নাট্যশালায় বহু সস্তা জিনিসের প্রবেশপথ করে দিয়েছিল। ভারতীয় গণনাট্য সংঘ স্রেফ চট টাঙিয়ে অভিনয় করে ঐ জীর্ণ ব্যবসায়িকতার মৃত্যুবাণ হানেন। বুর্জোয়া বাস্তববাদের বিরুদ্ধে ‘নবান্ন’ ছিল শ্রেণীসচেতন গণনাট্য সংঘের অভিযান।”
নাটক রচনার তাগিদ ও মানসিকতা বোঝাতে গিয়ে বিজন বলেছেন—”সেই সময় ডি. এন. মিত্র স্কোয়ারের পাশ দিয়ে রোজ আপিস যাই। রোজই দেখি গ্রামের বুভুক্ষু মানুষের সংসারযাত্রা, নারী-পুরুষ-শিশুর সংসার। এক একদিন এক একটা মৃতদেহ নোংরা কাপড়ে ঢাকা। মৃতদেহগুলো যেন জীবিত মানুষের চেয়ে অনেক ছোট দেখায়। বয়স্ক কি শিশু, আলাদা করা যায় না, … আপিস থেকে ফিরবার পথে রোজই ভাবি, এইসব নিয়ে কিছু লিখতে হবে। কিন্তু কীভাবে লিখব? ভয় করে গল্প লিখতে, সে বড় সেন্টিমেন্টাল প্যানপেনে হয়ে যাবে। একদিন ফেরবার পথে কানে এলো, পার্কের রেলিঙের ধারে বসে এক পুরুষ আর এক নারী তাদের ছেড়ে আসা গ্রামের গল্প করছে, নবান্নের গল্প, পুজো-পার্বণের গল্প। ভাববার চেষ্টা করছে তাদের অবর্তমানে গ্রামে এখন কী হচ্ছে। আমি আমার ফর্ম পেয়ে গেলাম। নাটকে ওরা নিজেরাই নিজেদের কথা বলবে।”
.jpg?1563364128311)
মাত্র ন’দিনে লেখা হয় ‘নবান্ন’। নাটক শুনে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বিজনকে বলেছিলেন—”আপনি তো জাত চাষা”। সত্যিই তো, বিজন মাটি ও তার ভাষাকে ঠিক চিনতেন। তিনি অক্লান্ত ঘুরে বেড়িয়েছেন আখড়ায় আখড়ায়, মালো পাড়ায়, শোলার কারিগরদের ঘরে ঘরে। অক্লেশে বলতেন—”সব কিছুর মধ্যে গিয়ে বসতাম, প্রতিমা গড়া দেখতাম, একটু কাদা মেখে দেওয়ার সুযোগ পেলে খুব ভালো লাগত। আমার মাখা কাদা দিয়ে যদি প্রতিমার নাকটা হয় তাহলে আমার যেন ধন্য মনে হত।”
‘আবেগ না হলে বোধহয় কবিতার জন্ম হয় না – অনুভূতি না থাকলে , জীবনযন্ত্রণা না থাকলে কোনো সৃষ্টিই বোধহয় সম্ভব নয়।’ -একথাই মনে ধরে রেখে বলে গিয়েছেন বিজন......... যাবজ্জীবন।
 In English
													
