খিদিরপুর অঞ্চলের এই কৈলাসভূমিকে কেন্দ্র করে একসময় গড়ে উঠেছিল বহু দেবস্থান

ভূকৈলাস রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা জয় নারায়ণ ঘোষাল। তিনি প্রথম রাজবাহাদুর উপাধি পেয়েছিলেন। খিদিরপুর সন্নিহিত অঞ্চলের ঘোষাল রাজ পরিবার একসময় বহু দেবদেবীর মন্দির গড়ে তুলেছিলেন। তাই ওই অঞ্চলটিকে ভূকৈলাস নামে ডাকা হত। বাংলা ১১৫৯ অর্থাৎ ইংরেজি ১৭৫২ সালে গড়গোবিন্দপুর অঞ্চলে জন্ম ভূকৈলাস রাজ পরিবারের উত্তরসূরী জয় নারায়ন ঘোষালের। জয় নারায়ণের দাদু কন্দর্প ঘোষাল ব্যবসা সূত্রে গোবিন্দপুর গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেছিলেন। তখনও আজকের কলকাতা জন্ম নেয়নি। কন্দর্প

ঘোষালের সময় থেকেই ঘোষাল বংশের ভালো সময় শুরু হয়। শোনা যায় তাদের আদি বাড়ি ছিল হাওড়ায়। বাকসাড়া।

 

কলকাতায় যে সমস্ত বনেদি পরিবার আর্থিক দিক থেকে প্রভাবশালী ছিলেন, তারা বেশিরভাগই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই ঘোষাল পরিবার শুরু করেছিলেন নুনের ব্যবসা দিয়ে। তবে পরবর্তীকালে কন্দর্প ঘোষাল নবাব সরকারের চাকরি করতেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গোবিন্দপুরে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ তৈরি শুরু করলে কন্দর্প ঘোষাল আবার বাকসাড়ায় ফিরে যান। কিন্তু হাওড়া থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য চালাতে অসুবিধা হচ্ছিল। তাই পরে খিদিরপুরে বাড়ি তৈরি করে পাকাপাকিভাবে থাকা শুরু করেন। কন্দর্প ঘোষালের তিন ছেলে। কৃষ্ণচন্দ্র, গোকুলচন্দ্র ও রামচন্দ্র। কৃষ্ণচন্দ্রের একমাত্র ছেলে জয় নারায়ন। কৃষ্ণচন্দ্রও তাঁর বাবার ব্যবসা ও বৈষয়িক বুদ্ধি দিয়েই ব্যবসা শুরু করেছিলেন। চাকরি ও ব্যবসা দুটোই করতেন তিনি। কলকাতার সমস্ত বনেদি পরিবারের মধ্যে এই ঘোষাল বংশের উত্তরসূরিরা চাকরি ও ব্যবসা একসঙ্গে করেছেন। তাও দক্ষতার সঙ্গে। তাই বহু অর্থ উপার্জন করেছেন। সাধক কবি রামপ্রসাদের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল। অর্থ এবং ধর্মনিষ্ঠা দুইই ভূকৈলাস রাজ পরিবারকে অনন্য স্থান দিয়েছিল। অনেকগুলি মন্দির তৈরি হয়েছিল এই পরিবারের তত্ত্বাবধানে।

 

জয় নারায়ণ ঘোষালের কাকা গোকুল চন্দ্র বাংলার তৎকালীন গভর্নর দেওয়ান ছিলেন। সিরাজদৌলার আক্রমণে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং কলকাতার ক্ষতি হচ্ছিল। মীরজাফর নবাব হওয়ার পর লর্ড ক্লাইভ কোম্পানির পক্ষে তার কাছে ১ কোটি ৭০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়েছিলেন। মীরজাফর নবাব হওয়ার পর সেই টাকা দেন। কোম্পানি ও কলকাতার লোকেদের মধ্যে কিভাবে ওই টাকা ভাগ করে দেওয়া হবে তা ঠিক করার জন্য মোট ১৩ জন কমিশনার নিযুক্ত করা হয়েছিল। এদের মধ্যেই একজন অন্যতম ছিলেন গোকুল চন্দ্র ঘোষাল। কন্দর্প ঘোষাল ও কৃষ্ণচন্দ্র ঘোষালের থেকে গোপাল চন্দ্র ঘোষাল যথেষ্ট প্রতিপত্তিশালী ছিলেন। ত্রিপুরার রাজাকে একটি মামলায় সাহায্য করার জন্য তিনি কৃতজ্ঞতাস্বরূপবশত তাঁকে কয়েকটি গ্রাম করহীন ভাবে দান করেছিলেন।

 

জয় নারায়ণ সংস্কৃত, বাংলা, আরবি, ফারসি ও ইংরেজি ভাষায় বেশ দক্ষ ছিলেন। নবাবের দরবারে তাই চাকরি পেতে অসুবিধা হয়নি। যদিও নানা কারণে সেই চাকরি তিনি বেশি দিন করেননি। পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে চাকরি করতেন তিনি। কলকাতা, যশোর, ঢাকায় দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছিলেন। সাড়ে তিন হাজারই মনসবদারের সনদ এনে দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে জয়নারায়ণ ঘোষাল তাঁর কাজ এবং দক্ষতার জন্য মহারাজা বাহাদুর খেতাব পেয়েছিলেন। জয় নারায়ন সবদিক থেকে এই পরিবারের যোগ্য সন্তান ছিলেন। পরিবারকে অনুসরণ করে রাজকার্যের সঙ্গে ব্যক্তিগত ব্যবসাও চালিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। নুন, সোনা ও রত্নের ব্যবসা করতেন। প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন। তিনি খিদিরপুরের পৈত্রিক বাসভবনের কাছে ১০৮ বিঘা জমি কিনে পরিখা বেষ্টিত একটি প্রাসাদ তৈরি করেন যেটি পরবর্তীকালে ভূকৈলাস রাজবাড়ি হিসেবে পরিচিত হয়। একটি দীঘিও খনন করেন তিনি। এই দিঘির পূর্ব ও পশ্চিম পাড়ে মা ও বাবার নামে তিনি শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করিয়েছিলেন।

 

চাকরি, ব্যবসা ও ধর্মচর্চাতেই জয়নারায়ণ তাঁর সারাজীবন কাটিয়ে দেননি। শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রসারেও তিনি বিশিষ্ট ভূমিকা নিয়েছিলেন। কাশীতে বিদ্যালয় তৈরি করে সেখানে ইংরেজি শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। সংস্কৃত, বাংলা ইত্যাদি চর্চার পাশাপাশি ইংরেজি চর্চাও শুরু করেছিলেন এই রাজ পরিবার।

 

কলকাতায় বহু দান-ধ্যান করেছেন এই পরিবারের উত্তরসূরীরা। জয় নারায়ণ কলকাতার অনাথ আশ্রম স্থাপনের জন্য জমি দিতে চেয়েছিলেন। তার নির্দেশ ছিল ভূকৈলাস দেবোত্তর আয় থেকে যেন দেব-দেবীর পুজো ও জনহিতকর কাজ করা হয়। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসকে চিত্তরঞ্জন সেবা সদন তৈরির জন্য এককালীন ৬০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছিল। বিভিন্ন হাসপাতাল তৈরির ক্ষেত্রে এরা অর্থ সাহায্য করেছেন।

 

বিরাট বাড়ি হলেও স্থাপত্যের দিক থেকে এই বাড়ির সাধারণ। অন্দর ও সদর নিয়ে তৈরি। এই বাড়ির মূল দ্রষ্টব্য হল দেবদেবীর মূর্তি। পূজার মূর্তি, দেবদেবীর বিগ্রহ ও শিবমন্দিরগুলি আজও ভূকৈলাস রাজবাড়ীর অন্যতম দর্শনীয় অংশ। দক্ষিণমুখী এই বাড়ির পশ্চিমে খিদিরপুর ডক। খিদিরপুর ট্রামডিপোর উল্টোদিকে একটি গলি দিয়ে ঢুকতে হয় রাজবাড়ীটিতে। মন্দিরগুলি সংস্কার করা হয়েছে। পরিবারের উত্তরসূরীরা নানাভাবে বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের চেষ্টা করেছেন। তবে ইতিহাসের পাতায় এই বাড়ির অস্তিত্ব ম্লান। কিন্তু কলকাতার বুকে অন্যতম অজানা দর্শনীয় স্থান হিসেবে আজও টিকে রয়েছে এই বাড়ি।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...