উত্তর চব্বিশ পরগণার এক প্রান্তিক জনপদ বসিরহাট। অনতিদূরে ওপার বাংলা, বয়ে চলেছে ইছামতি। বাদাবনের শুরু এই অঞ্চল থেকেই। সংগ্রাম কালী, কুলেশ্বরী কালী, জোড়া কালী ইত্যাদির মতো একাধিক প্রসিদ্ধ কালী রয়েছে এই অঞ্চলে। রয়েছেন আরও এক দেবী কালী, তাঁর নাম বেতশ্রী কালী। বসিরহাটের কুমারপুকুরে রয়েছে বেতশ্রী কালী মন্দির। এই মন্দির নিয়ে রয়েছে একাধিক লোককাহিনি যা ইতিহাসের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। ঠিক কোন সময়ে এই মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা আর নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। জনশ্রুতি অনুযায়ী, এই মন্দিরের বয়স তিনশো বছরের বেশি। আবার কেউ কেউ বলেন বেতশ্রী কালী মন্দির ৩৫০ বছরের পুরনো। আগে মন্দির ছিল না। এখন স্থায়ী মন্দির তৈরি হয়েছে।
কুমারপুকুর, একেবারে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষে অবস্থিত এক গ্রাম, অন্যদিকে রয়েছে সুন্দরবন। এই গ্রামেই বেতশ্রী কালী পুজো পাচ্ছেন প্রাচীন কাল থেকে। জনশ্রুতি অনুযায়ী, জনৈক
মৎসজীবী অলি চৌধুরী মাছ ধরতে গিয়ে দেবী কালীর মূর্তি পেয়েছিলেন। তাঁর মাছ ধরার জালে বেঁধে উঠে এসেছিল দেবী মূর্তি। সময়টা ছিল মোঘল আমল। মোঘলদের সুবেদারেরা তখন বাংলা চালাচ্ছেন। আবার আর একটি মতে জঙ্গলের মধ্যে এক সময় দেবী কালীকে দেখতে পেয়েছিলেন তিনি। তারপর মা কালীর স্বপ্নে পুজো করার আদেশ পান। এখন যেখানে কালী মন্দির, তার পিছনে এক বেত বাগানে দেবী কালীর শুরু করেন অলি চৌধুরী। বেত বাগানে পুজো থেকেই দেবী নাম হয় বেতশ্রী কালী। অলি চৌধুরীর বৃদ্ধ বয়সে পুজোর দায়ভার কাঁধে তুলে নেন প্রাণকৃষ্ণ আচার্য নামে এক ব্রাহ্মণ।
এই মন্দিরে বার্ষিক পুজো হয় মাঘ সংক্রান্তিতে অর্থাৎ মাঘ মাসের শেষ দিনে। জানা যায়, মাঘের শেষ দিনেই মায়ের মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মন্দিরে। আজও ফি বছর বাংলা সনের মাঘ মাসের শেষ শনিবার দেবী কালীর বিগ্রহ স্থাপন করা হয় মন্দিরে। মহাসমারোহে দেবীর পুজো করা হয়। সেই সময় মেলা বসে।বাংলা সনের মাঘ মাসের শেষ শনিবার কালী মায়ের পুজো উপলক্ষ্যে এই মেলার সূচনা হয়, মেলা চলে পরবর্তী শনিবার পর্যন্ত। মন্দির চত্বরের পার্শ্ববর্তী মাঠে হরেক রকমের দোকান বসে। পশ্চিমবাংলার পাশাপাশি ভিন রাজ্য থেকেও মানুষ আসেন এই মেলায়। এলাকার অধিকাংশ মানুষই ইসলাম ধর্মাবলাম্বী। কালীপুজোয় সকলেই অংশগ্রহণ করে। হিন্দু-মুসলমানের ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে সাক্ষী এই মন্দির। একদা জেলে পাড়ার এক মুসলমানের হাতে গড়ে উঠতেন মা। আজও প্রথা মেনে সেই পাড়ার এক মুসলমান বাড়ির মাটি দিয়েই তৈরি হয় দেবীর মূর্তি।
বেতশ্রী কালী মন্দির পুজোর সময় মিলনক্ষেত্রে পরিণত হয়। পুজো যাবতীয় কাজে মুসলমানদের সক্রিয় অংশগ্রহণ অন্যান্য মন্দিরে খুব একটা দেখা যায় না। প্রাচীন কাল থেকেই এই মন্দিরে এ জিনিস লক্ষ্য করা যায়। মন্দির রক্ষণাবেক্ষণ থেকে মেলার আয়োজন সব করেন ইসলাম ধর্মের মানুষ। পুজোর ভোগ, দশর্কমার বাজার সবই করেন মুসলমানরা। তাই আক্ষরিক অর্থেই বেতশ্রী কালী মন্দির বহু ধর্মের মিলনক্ষেত্র।