শোনা যায় ওয়ারেন হেস্টিংস-এর কলকাতায় নাকি দুটি বাড়ি ছিল। পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন তিনি, অন্যটিতে, নিজের জন্য একটি প্রাসাদ তৈরি করে রেখেছিলেন। এখানে ভারতবর্ষকে শাসন করার সময় সেই সংক্রান্ত নানা কাজকর্ম করতেন। ব্রিটিশের বিভিন্ন গোপন কার্যকলাপ সম্পন্ন করতেন এই বাড়িটিতে বসেই। শোনা যায় বৃদ্ধ ও অসুস্থ নবাব মীরজাফরকে তিনি নাকি এখানে কিছুদিন আশ্রয় দিয়েছিলেন। এই বাড়িটিই বেলভেডিয়ার হাউস। ওয়ারেন হেস্টিংস-এর একটি বাড়ি আলিপুরে, অন্যটি ও আলিপুরেএই তবে এটি একটি প্রাসাদ হিসেবেই পরিচিত। যাকে বেলভেডিয়ার প্রাসাদ বলে। ৭২ বিঘা ৮ কাঠা ৪ ছটাক জমির ওপর এই বাড়িটিতে হেস্টিংস তাঁর মান্যগণ্য অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাতেন মূলত। কথিত আছে বৃদ্ধ ও অসুস্থ নবাব মীরজাফরকে তিনি নাকি এই বাড়িতে কিছুদিন আশ্রয় দিয়েছিলেন।
মীরজাফর এই বেলভেডিয়ার প্রাসাদে আদৌ ছিলেন কিনা সেই নিয়ে কোন প্রামাণ্য তথ্য নেই।। তবে খুব বেশিদিন এই প্রাসাদ ওয়ারেন হেস্টিংসের দখলে ছিল না। ১৭৭৭ সালে হেস্টিংস এই প্রাসাদটি লিজ দিয়েছিলেন আরেক ব্রিটিশ নাগরিক মেজর টলিকে। তবে ১৭৮০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হেস্টিংস এই বেলভেডিয়ার হাউস মেজর টলিকে পুরোপুরি বিক্রি করে দেন। যদিও শোনা যায় ১৮০২ সালে আবার এই বাড়িটি বিক্রির জন্য ‘ক্যালকাটা গেজেট’ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল।
তারপর আবার হাত বদল হয় বাড়িটির। ১৮৫৪ সালে এই বাড়িটি লেফটেন্যান্ট গভর্নরদের সরকারি বাসভবন হিসেবে পরিচিত হয়। ততদিনে বাংলার অনেক গভর্নর এই বাড়িতে থেকেছেন। ১৭৬৯ সালে এই বেলভেডিয়ার হাউসে থাকতেন গভর্নর ভেরি লিস্ট। বাড়িটিকে তিনি ‘কান্ট্রি সিট’ বলতেন।
এমনটাও শোনা যায় নবাব মীরজাফর নাকি এই বাড়িটি উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংকে। যদিও এই বাড়ির মালিকানা নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। আলিপুরের পুরনো ও নতুন বাড়ি অর্থাৎ বেলভেডিয়ার হাউস ও হেস্টিং হাউসের যথার্থ মালিক ওয়ারেন্ট হেস্টিংস ছিলেন কিনা সে নিয়ে তথ্যের অভাব রয়েছে। হেস্টিংস-এর নিজস্ব চিঠি ও কোম্পানির নথিপত্র নানা সংশয় তৈরি করেছে।
স্থাপত্যের দিক থেকে বেলভেডিয়ার হাউস মিশ্র রীতির। সাধারণ অ্যাংলো ইন্ডিয়ান প্রাসাদ এটি। তবে ইতালির রেনেসাঁস স্থাপত্যশৈলের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এই বাড়িটির আশেপাশে একটি চমৎকার বাসভবন ছিল। পুকুরে পদ্মফুল ফুটত। চওড়া সিঁড়ির দুপাশে সাজানো ছিল লতাপাতা। প্রাসাদের উত্তর দিকে সিঁড়ি মাঝখানের বলরুম অর্থাৎ নাচ ঘরের কাঠের মেঝে তৈরি হয়েছিল ১৮৭৭ সালের নাগাদ। বাড়িতে বারবার রেনোভেশনের মধ্যে দিয়ে গেছে। ১৮৭৯ এবং ১৮৯০ সাল নাগাদ উত্তর-পূর্ব দিকে সুপার রুম তৈরি হয়। তারপর তৈরি হয়েছিল পশ্চিম দিকের দোতলার ঘর গুলি। আলেকজান্ডার ম্যাকেন্জির আমলে বেলভেডিয়ার ভবনে ইলেকট্রিক আলো জলে এবং তার কিছুকাল পদে পূর্ব দিকের বিশাল নাচ ঘর ও দরবার হল তৈরি হয়। প্রায় ১১৪ ফুট দৈর্ঘ্য ছিল।
বর্তমানে এই বেলভেডিয়ার হাউস ন্যাশনাল লাইব্রেরী। জাতীয় গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ বাড়িটির পুরনো চেহারা অবিকৃত রেখেও রক্ষণাবেক্ষণ করেছেন। বেলভেডিয়ার হাউস প্রাঙ্গণে গড়ে উঠেছে আরও নতুন বাড়ি। পরিখার দিকেও আরেকটি বাড়ি তোলার কথা চলেছে। কলকাতার এই প্রাচীন স্থাপত্য এভাবেই আজও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে টিকে রয়েছে।