সবার প্রিয় দাদামণি

ছেলেটির নাম কুমুদ... কুমুদ লাল গঙ্গোপাধ্যায়। বাবা কুঞ্জলাল গঙ্গোপাধ্যায় নামকরা উকিল । বিহারের ভাগলপুরে তার মামার বাড়ি। ছোটবেলায় বেশিরভাগ সময় মামাবাড়িতেই থাকতো সে। কুমুদ লালের মাতামহ শিবচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সহপাঠী। তিনিও উকিল ছিলেন এবং ওকালতি করে তখনকার দিনে কোটিপতি হয়েছিলেন। এই শিবচন্দ্রকে লোকে রাজা বলতো। তাঁর বাড়িতে শিক্ষা সংস্কৃতির একটা আবহ ছিল।  সে বাড়িতে তখন আসতেন  ঔপন্যাসিক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, বনফুল, হেমেন রায়রা। আর তাঁরা আসলেই শিবচন্দ্র ছোট্ট কুমুদকে তাঁদের কাছে নিয়ে গিয়ে বলতেন "আচ্ছা, খোকা ওই গল্পটা বলো তো দেখি, যেখানে তোমার কাঁধে ডানা গজাল।’’ খোকা মহানন্দে বলতে শুরু করে.... কেউ মজা করে বললেন , ‘‘তা, ডানা গজিয়ে দেখাও তো।’’ খোকার জবাব রেডি, ‘‘তুমি বাঘ হয়ে দেখাও তো, তবেই আমি ডানা বার করব।’'...

শিবচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই দৌহিত্রটি বড় হয়ে কলকাতায় আইন পড়তে এলেন এবং তাঁর বোন সতীদেবীর বিয়ে হ‌লো শশধর মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে যিনি বম্বেতে বিখ্যাত চিত্রপরিচালক হিমাংশু রায়ের অফিস বম্বে টকিজ-এ সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারের চাকরি পেলেন। এতে সবথেকে বেশি খুশি হলেন কুমুদ। নিজে পরে বলেছেন, ‘‘হতচ্ছাড়া আইনের ক্লাসের থেকে ওটায় বেশি ইন্টারেস্ট হতে লাগল। ল-এর সেকেন্ড ইয়ারের এগজ়ামের ফি-র টাকায় বম্বের ট্রেনের টিকিট কিনে সোজা শশধরের বাড়িতে। সে বম্বে টকিজ়ে আমার জন্য ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্টের চাকরিও দেখে রেখেছিল।’’

কুমুদকে দেখামাত্র হিমাংশু রায় অভিনয় করাতে চাইলেন। কিন্তু আপত্তি জানালেন  বম্বে টকিজ়ের জার্মান ডিরেক্টর ফ্রান্জ় অস্টেন। "এর চিবুকে এতটুকু কাটা কাটা ভাব নেই। জঘন্য দেখাবে ক্যামেরায়।"...  কুমুদও রেগে আগুন - কে চেয়েছে অভিনয় করতে! সামলে দিলেন হিমাংশু রায়। তিনি বোঝালেন, "তুমি ডিরেক্টর হতে চাও তো? তবে সব শিখতে হবে। চিত্রনাট্য লেখা, ফিল্ম ল্যাবের কাজ, মেকআপ, অ্যাক্টিংও"।

তখন বম্বে টকিজ়ের হিরো নাজমুল হাসান আর হিরোইন হতেন হিমাংশুর তরুণী স্ত্রী দেবিকা রানি। "জীবন নইয়া" ছবির শুটিং শুরু হতেই হিমাংশু রায়ের স্ত্রী সেই নায়কের হাত ধরে কলকাতা পালিয়ে গিয়েছিলেন। বহু চেষ্টায় তাঁকে ফেরত আনা হল। তবে নাজমুলকে আর বম্বে টকিজ়ে ঢুকতে দেওয়া হলো না। কুমুদকেই নায়ক হিসেবে মনে ধরল হিমাংশুর। সারল্য ভরা ছেলেমানুষ মুখ, চেহারায় আলগা শ্রী। আর তাঁর অসাধারণ সুপুরুষ হিরোয়  দরকার নেই। শশধরের শালাবাবুই তাঁর ছবির নায়ক হবেন! কুমুদ লাল পাল্টে রাখা হলো নতুন নাম "অশোক কুমার", জন্ম হল এক নতুন তারকার। পরবর্তী ষাট বছর যে অভিনেতা বম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে দাপটে কাজ করেছিলেন।

সে দিনের কথা উঠলেই হাঁ হাঁ করে উঠতেন অশোককুমার।  তিনি বলতেন, ‘‘আমাকে হিমাংশু রায় হিরো করে দিল,  বাড়িতে সবাই বলল আমি বখে গেছি, আমাকে এ বার পরিতে ধরে নিয়ে যাবে। বাবা বম্বে ছুটে এলেন। শশধর তাঁকে বোঝাতে না পেরে হিমাংশু রায়ের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিল।’’ । মিটিং শেষে বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে বললেন, ‘‘মন দিয়ে অভিনয় করো।"..

সেই "জীবন নইয়া"তে অশোক যা অভিনয় করলেন, ভোলার নয়।  তাঁর কথায়, .."এক দিন আবার আমাকে দেবিকা রানির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ দৃশ্যে অভিনয় করতে হবে। একে তিনি আমার বসের স্ত্রী, তার ওপর ওপাশে সোফায় আমার মা বসে আছেন। আমি ঘেমেনেয়ে একশা। হিরোইনকে একটা হার পরানোর কথা ছিল। সেটা আমি তার চুলে গেঁথে বসলাম। সেটা ছাড়াতে গিয়ে দেবিকা রানির বেশ কয়েক গাছি চুল উঠেই গেল। আমি নিশ্চিন্ত হলাম, আর পরদিন থেকে যেতে হবে না। কিন্তু ছাড়ল না।"...

এত কিছুর পরও পরের ছবি "অচ্ছুৎ কন্যা"য় ও তাঁকে দিয়েই অভিনয় করানো হল। তিনি তো আশাই করেননি।...." কিন্তু বলা হল, প্রথম সিনেমায় আমার চুল সকলের খুব পছন্দ হয়েছে।’’...

"অচ্ছুৎ কন্যা"র শুটিং শুরুর আগে হিমাংশু রায় অশোককুমারকে বিদেশি সিনেমা দেখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে ফিল্মের খুঁটিনাটি জানতে প্রচুর বইও পড়তে দিয়েছিলেন। সে সব দেখেশুনে অশোক বুঝলেন, তিনি অভিনেতা হিসেবে যথেষ্ট আড়ষ্ট। তিনি তাঁর প্রকাশভঙ্গিকে আরও তীক্ষ্ণ করার চেষ্টা শুরু করলেন। এবার তাঁর মনে হতে লাগল, এই মাধ্যমটিকে ভালবেসে ফেলছেন তিনি। এর সঙ্গেই পর্দায় তাঁর অভিনয়ে নানা বৈচিত্র দেখা দিতে লাগল। "বচন"-এ রাজপুত শৌর্য, "ইজ্জত’"-এ দেশি রোমিওর ভূমিকায় তাঁর অভিনয় সকলের নজর কাড়ল। 

হিমাংশু তাঁকে কমিক আর ভিলেন, দু’রকম চরিত্র করতেও  নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু অশোক বিচিত্রবর্ণের মানুষ, তাঁর সব রকমটাই করতে ইচ্ছে করতো। হিমাংশুর মৃত্যুর পরে বম্বে টকিজ়ের যখন ঘোর দুর্দিন, তখন শশধর, তাঁর বন্ধু জ্ঞান মুখোপাধ্যায় আর অশোককুমার একসঙ্গে বসে ভেবেচিন্তে ঠিক করলেন, একঘেয়ে প্রেমের পানসে গল্প দিয়ে আর সিনেমা বানানো ঠিক হবে না। কয়েকটা বিদেশি ছবির অনুপ্রেরণায় নতুন থিম ভাবলেন তাঁরা। সেই থিমেই ‘"কিসমত" হল। মুখ্য চরিত্র আড়চোখে লোককে দ্যাখে, ঠকায়, দাঁতে সিগার চেপে ধোঁয়া ছাড়ে। অশোক কুমার দেখলেন ভিলেনের চরিত্রেও তিনি দিব্যি অভিনয় করেন। ১৯৪৩ সালে মুক্তি পাওয়া এই ছকভাঙা ছবিটি দীর্ঘদিন ভারতের সফলতম ছবি ছিল। পরে সে রেকর্ড ভাঙে "শোলে"।  এই লেডিকিলার লুক আর ক্যারেক্টারে পরেও অশোককুমারকে পর্দায় দেখা গিয়েছে। "হাওড়া ব্রিজ", "ভাই ভাই"... পুরোদস্তুর ভিলেন হয়ে মাতিয়ে দিয়েছিলেন ‘"জুয়েল থিফ"-এ।

‘‘তা বলে মানুষটা আমি ভিলেন ছিলাম না। আমি তো নতুন হিরোও খুঁজতাম। একদিন একটা বেশ সুন্দর দেখতে ছেলে এসে আমার কাছে কাজ চাইল। আমি তাকে 'জ়িদ্দি'র নায়কের চরিত্রটায় নামানোর ব্যবস্থা করলাম। সে ছেলে কোত্থেকে যেন দেবানন্দ হয়ে গেল।".... একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন  দাদামণি। (হ্যাঁ, তাঁর ছোট দুই ভাই আর বোন সতীদেবী তাঁকে দাদামণি বলে ডাকতেন, তাই পুরো ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে সবাই তাঁকে দাদামণি ডাকতে শুরু করে।) জানিয়েছিলেন, এক দিন একটা লম্বা মতো ছেলে সেটে বসে কী সব নোট নিচ্ছিল দেখে তিনি তাকে বের করে দিতে গিয়েছিলেন। পরে দেখা গেল, সে "পথের পাঁচালি" বানিয়ে ফেলেছে। তখন ও তিনি জানতেন না যে সেই "লম্বা মতো ছেলেটি"ই সত্যজিৎ রায়...  যদি জানতেন সে-ই সত্যজিৎ রায়, তবে আরও আদরযত্ন করলে নিজেরই উপকার হত বলে কপট দুঃখ করতেন। 

আটটা ভাষা শিখেছিলেন তিনি! হিন্দি, উর্দু, ইংরেজিতে চোস্ত ছিলেন।  কত সময়ে নিজের ডায়লগ সেটে গিয়ে নিজেই বানিয়ে বলে দিতেন। সেই ভাবেই তাঁর আর প্রাণের অপূর্ব রসায়ন, কমিক টাইমিংয়ের গুণে "ভিক্টোরিয়া নম্বর ২০৩" বাম্পার হিট!

অশোককুমার চরিত্রাভিনয়েও অনবদ্য। "খুবসুরত"-এ অশোকের পুরো চরিত্রটাই তাঁর নিজের জীবন থেকে অনুপ্রাণিত। এর আগে ‘চলতি কা নাম গাড়ি’তে তিন ভাই অশোক কুমার, অনুপকুমার এবং কিশোর কুমার নিজেদের ভূমিকাতেই অভিনয় করেছিলেন।

প্রতিভার দিক দিয়েও তিনি ছিলেন অনন্য। দাবা খেলতে জানতেন, বক্সিং-ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন, ননসেন্স রাইম রচয়িতা, অসাধারণ গায়ক, দুর্দান্ত পেন্টার এবং ভারতের অন্যতম সফল হোমিয়োপ্যাথিক চিকিৎসক। রোজ সকাল সাতটা থেকে ন’টা বাড়িতে চেম্বার করতেন। লম্বা লাইন পড়ত।

খেতে ও খাওয়াতে খুব ভালবাসতেন। ব্রেক হলেই বলতেন, ‘‘চারটে করে শিঙাড়া আন সবার জন্য।’’

অভিনয়ের জন্য কী না করেছেন তিনি! প্রথমে তাঁর গলার স্বর শুনে সবাই বলেছিল মেয়েলি আওয়াজ। সেই থেকে বরফ গিলে গিলে গলা খসখসে করেছেন তিনি! তবলা টেনে বসে চৌখস ভঙ্গিতে গেয়েছেন, "বনবাউরি, ম্যায় হারি, যা যা রি।"

অশোককুমারের থেকে বলিউড আজও শিখেই চলেছে। শিখেছে হিরোদের নামকরণ। দিলীপকুমার, রাজেন্দ্রকুমার হয়ে অক্ষয়কুমার অবধি। তাঁর ভাবা গল্পেরই সুতো ধরে আজও নতুন নতুন হিট সিনেমার ফর্মুলা তৈরি হয়ে চলেছে মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি তে। "মহল" থেকে "করণ অর্জুন", "পাকিজ়া" থেকে ‘উমরাও জান’,  "ভিক্টোরিয়া নম্বর ২০৩" থেকে "আন্দাজ় অপনা অপনা", আবার "বন্দিশ" থেকে "হম আপকে হ্যায় কৌন"...  সব হিট ছবির মূল আইডিয়া কিন্তু খোদ অশোক কুমারের। দাদামণিই এই সব কাহিনির সূত্রধর। তাঁর ধরিয়ে দেওয়া কাহিনী সূত্র মেনেই  নতুন নতুন ছবি তৈরি করা হচ্ছে  বলিউডে।

অভিনয় জীবনে বহু পুরস্কারে পুরস্কৃত অশোক কুমার ১৯৮৮ সালে পেয়েছিলেন দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার এবং ১৯৯৯ -এ পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত হন।

দাদামণি অশোক কুমার সবথেকে বেশি আঘাত পেয়েছিলেন সন্তানসম ছোট ভাই কিশোর কুমারের মৃত্যুতে। তাঁর জন্মদিন আর কিশোর কুমারের মৃত্যু একই দিনে...১৩ই অক্টোবর। কিশোর কুমারের প্রয়াণের পর আর কখনো নিজের জন্মদিনে কোনো উৎসব পালন করেন নি তাঁর পিতৃসম প্রিয় দাদামণি।

 

 

 

ঋণ: বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধ এবং

‘জ়িন্দেগি এক সফর’: সন্দীপ রায়ের তথ্যচিত্র

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...