বাংলার নিজস্ব হাট

 

বাংলার নিজস্ব কৃষ্টি, নিজস্ব শিল্পকলা, নিজস্ব বয়নশিল্প যথেষ্ট সমৃদ্ধ, তা আর বলার অবকাশ রাখেনা। বাংলার গ্রামে গ্রামে রয়েছে এমন সব শিল্পী, যাঁরা আজও এই সব শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছেন নিজেদের কাজের মধ্যে দিয়ে। তাদের শিল্পের বিকাশে সহায়তা করতে এগিয়ে এসেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। কলকাতার ইকো পার্ক এমনই একটি জায়গা, যেখানে এইরকম বহু শিল্পীদের নিজস্ব শিল্প প্রদর্শন ও বিপননের ব্যবস্থা করে দিয়েছে রাজ্য সরকারের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প দফতর। ‘বিশ্ব বাংলা হাট| ইকো পার্কের পাঁচ নম্বর গেট দিয়ে ঢুকলেই আপনি পৌঁছে যাবেন এক অজানা জগতে। একটু ভেতরে গেলেই মনে হবে যেন গ্রামের হস্তশিল্পের প্রদর্শনেই চলে এসেছেন আপনি। বিভিন্ন ছোট ছোট স্টলে সাজানো রয়েছে বাংলার বিভিন্ন রকম হস্তশিল্প সামগ্রী। পাশাপাশি ঢালাও চাতালে রয়েছে এমনই বহু কারিগর, যাঁরা আপনার সামনেই কাজ করে আপনাকে আপনার পছন্দমত সামগ্রী দিয়ে দিতে প্রস্তুত।

    পায়ে পায়ে চলে গিয়েছিলাম একদিন ঘুরতে ঘুরতে। গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকেই মস্ত দেওয়ালে রঙিন পটচিত্র আপনাকে হাতছনি দিয়ে ডাকবে। সেই পটচিত্রের অন্যতম কারিগর কল্পনা চিত্রকর রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছেন তাঁর সৃষ্টির স্বীকৃতিস্বরূপ। তার পাশেই রয়েছে নদীমাতৃক বাংলার একান্ত নিজস্ব নৌকার রেপ্লিকা, তাও আবার ডোকরার শিল্পের আকারে তৈরী করা। ভেতরে আছে খাবারের আয়োজনও। চাইলে আপনি টুক করে কিছু খেয়েও নিতে পারবেন। আছে একটি মুক্তমঞ্চ, যেখানে বাংলার বাউল-ভাটিয়ালি গানের আসর বসে মাঝে মাঝেই। এবারে চলে আসুন একেবারে ভেতরের দিকে, যেখানে রয়েছে ছোট ছোট স্টল সহ বিভিন্ন জিনিসের দোকান।

কিনতে পারেন আপনি যতক্ষণ খুশি সময় হাতে নিয়ে। কেউ আপনাকে তাড়া দেবেনা। জানতে পারবেন সেই বিশেষ জিনিসের সম্বন্ধে, উপস্থিত শিল্পীদের কাছ থেকে।

     আলাপ হয়ে গেল বেশ কিছু শিল্পীদের সঙ্গে। অনেকক্ষণ গল্প করলাম লিলি-দি' সঙ্গে। ৩৫ বছর ধরে সেলাই-ফোঁড়াই করছেন। ভালোবেসে করেন এই কাজ। বললেন শুরু থেকেই এই বিষয় নিয়েই পেশাদার হিসেযে কাজ করার ইচ্ছে ছিল। তাই ডিপ্লোমা কোর্স করে নিয়েছিলেন। যথেষ্ট সুনামের সঙ্গে হস্তশিল্পের কাজ করে এসেছেন তিনি। প্রচুর লোকজন কাজ করতেন তাঁর সঙ্গে। এখন একটু বয়স হয়ে যাওয়ায় ব্যবসার আয়তন কমিয়ে এনেছেন। লিলিদি হাসতে হাসতে বললেন, " যদিও ব্যবসার খাতিরে শুরু করেছিলাম, কিন্তু এখন নিজে হাতে কিছু না কিছু সেলাই না করে একদিন ও থাকতে পারিনা। মেয়েরা কাজ করলেও আমি নিজে হাতে কাজ করতেই ভালোবাসি।" তিনি কাঁথা, বাটিক, ক্রুশের কাজ-ই করেন মূলতঃ। যুক্ত রয়েছেন বেশ কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- আর্টিসান্স অফ বিশ্ব বাংলা, আর্টিসান্স অফ মিনিস্ট্রি অফ মাইক্রো, স্মল এন্ড মিডিয়াম, আর্টিসান্স অফ ইপিসি, আর্টিসান্স অফ কারিগরি ভবন, আর্টিসান্স অফ এনসিপিসিডি মিনিস্ট্রি অফ টেক্সটাইলস। এত কিছু জানার পর আমার তো চোখ কপালে.... হাসিখুশি লিলি'দি বললেন, "সেলাই বা জিনিসের সঙ্গে আমি আপোষ করিনা। ফাঁকি দিয়ে জিনিস বিক্রি করায় আমি বিশ্বাসী নই, তাই এতকিছু জায়গার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে পেরেছি"।

   (লিলি সরকার)   

 

জানলাম, রাজ্য সরকারের তরফে এখানে শিল্পীদের এই স্টলগুলি দেওয়া হয়েছে। প্রতিদিন সকালে শিল্পীরা এখানে আসেন জিনিস বিক্রি করতে, আবার বিকেলে/সন্ধ্যাবেলায় বাড়ি ফিরে যান। স্থায়ী এই হাট সাধারণ মানুষের জন্য খুলে রাখতে সরকারি তরফে রোজ শিল্পীদের যাতায়ত ভাড়া দেওয়া হয়, এছাড়াও দৈনিক ৭৫ টাকা করে পান প্রতি শিল্পী। এছাড়া যেদিন যেমন বিক্রি হবে, সেটা পুরোটাই শিল্পীর আয় হিসেবে বিবেচিত হবে। শুনে খুব খুশি হলাম। এই হাটের ব্যাপারে শুনেছিলাম কিন্তু এভাবে সরকারি তরফে উদ্যোগ নিয়ে কাজকর্ম করানো হচ্ছে, তা জানা ছিলনা। 

  (আরতি পন্ডিত)  

 

আলাপ হল বারাসাত থেকে আসা রেবা ঘোষের সঙ্গে। বয়স্ক মহিলা চরকায় সুতো কাটছেন। জিজ্ঞেস করলাম কেমন লাগে এখানে? হাসতে  হাসতে  বললেন, ভালোই লাগে।

(রেবা ঘোষ)

 

আছে বিভিন্ন রকম গয়না। দেখলে আপনি চোখ ফেরাতে পারবেননা। এক্সক্লুসিভ একেবারে। একটার সঙ্গে একটার মিল নেই। লাইভ তৈরী হচ্ছে সব। হাটের বিক্রেতারা সকলেই খুব খুশি আমায় পেয়ে। ওদের নিয়ে লেখা হবে শুনে আনন্দের সীমা নেই। ছবি তুলতে সকলেই আগ্রহ ভরে এগিয়ে এলেন।

  (অজিত জানা)  

 

তবে আমার কিন্তু মন ভরল না। সময় বলছিল ফিরতে হবে, তাই একান্তই ফেরা। বলে এলাম আবার আসব। গল্প করব পরে সকলের সঙ্গে, জানব সবার কথা। 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...