'প্রফেসর' আর্সেন ওয়েঙ্গার

১৯৯৬ সালে ট্রান্সফার নিয়ে বিতর্কের জেরে ব্রুস রিয়ক বরখাস্ত হন। অনেকেই ভাবছেন কোচ হিসাবে আসবেন ক্রুয়েফ। হল না, নতুন ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ করা হলো এক অজ্ঞাত ফরাসি কোচকে। যিনি বদলে দিয়েছিলেন আর্সেনাল ক্লাবের নেমসেক আর্সেন ওয়েঙ্গার। জাদু কাঠিতে ক্লাব তাঁবু ভরিয়ে দেন ।


সমর্থকরাও ভালোভাবে নেয়নি ওয়েঙ্গারের নিয়োগ। দিন যত গিয়েছে, ওয়েঙ্গার নিজেকে প্রমাণ করেছেন। নিজেকে ধীরে ধীরে তুলে নিয়েছেন খ্যাতির শিখরে, হয়ে উঠেছেন আর্সেনালের সমার্থক! তাঁর বিশেষ পরিচিতি ‘দ্য প্রফেসর’ নামে। ওয়েঙ্গারের জন্ম ১৯৪৯ সালের ২২ অক্টোবর। ফ্রান্সের আলসেশ প্রদেশের রাজধানী স্ট্রাসবার্গে অবস্থিত ছোট একটি গ্রাম ডুপিগহাইমে। তার বাবার নাম আলফোনস ওয়েঙ্গার এবং মায়ের নাম লুসি ওয়েঙ্গার। তিন ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। প্রকৃতির অদ্ভুত খেয়াল, জন্মের পর থেকেই বাবা-মা যেন আঁচ করতে পেরেছিলেন তাদের ছোট্ট সোনামণি আর্সেনালের হয়ে ডাগআউট কাঁপাবে; তাই হয়তো নামটাই রেখে দিলেন ‘আর্সেন’!

ওয়েঙ্গার পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। বাবার গাড়ির খুচরা যন্ত্রপাতির ব্যবসা আর মায়ের একটি ছোট্ট রেস্তোরাঁ - এই ছিল তাদের আয়ের উৎস। পড়াশোনায় দুরন্ত ওয়েঙ্গার ফুটবলের প্রেমে পড়েন। খেলোয়াড় হিসেবে ওয়েঙ্গারের অর্জনের খাতা খুব একটা পরিপূর্ণ নয়। বিভিন্ন অপেশাদারি ক্লাবে খেলার পরে পেশাদার ফুটবলার হিসেবে কেরিয়ার শুরু করতে তার বেশ সময় লেগে গিয়েছিল। অথচ বাবা স্থানীয় জুনিয়র ক্লাবের কোচ হওয়ার কারণে মাত্র ছয় বছর বয়সেই তিনি ফুটবলের খেলার সংস্পর্শে আসেন। তাছাড়া প্রায়ই বাবার সাথে জার্মানির বুন্দেসলিগার ম্যাচ দেখতে যেতেন। তখন থেকেই তার মধ্যে ফুটবল খেলার প্রতি আলাদা টান তৈরি হয়। ডাটলেনহাইম অঞ্চলটি অপেশাদারি ফুটবলের জন্যে বেশ সুপরিচিত ছিল। কিন্তু জনসংখ্যা অনেক কম হওয়ার কারণে সমবয়সী খেলোয়াড়দের নিয়ে একটি দল গঠন করা ছিল কষ্টসাধ্য। তার বয়স যখন বারো, তখন বাবার দায়িত্বাধীন দলের হয়ে অপেশাদারি ফুটবলে পা রাখেন ওয়েঙ্গার।

 

arsenewenger1

 


বাবার অধীনে খেলতে তিনি বেশ পছন্দ করতেন। তাছাড়া ভাইবোনদের মধ্যে তারই বাবার সাথে সখ্যতা ছিল বেশি, তাই বাবার দলে খেলতে পারাটা তার জন্য ছিল পরম আরাধ্য এক প্রাপ্তি। পনের বছর বয়স পর্যন্ত তিনি বাবার অধীনেই স্থানীয় ক্লাবে খেলতেন এবং তিনি দলের গুরুত্বপূর্ণ একজন খেলোয়াড় ছিলেন। তাই তার নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত জুনিয়র টিম ছেড়ে অন্য কোথাও যোগদান করেননি।

শারীরিক বৃদ্ধি কিছুটা ধীর হওয়ার কারণে পেশাদারী কোনো ক্লাবে খেলার জন্যে তার বেশ কিছু দিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল। তার বয়স যখন ষোল, তখন এফ.সি ডাটলেনহাইমের মূল দলে খেলার সুযোগ পান ওয়েঙ্গার। আর্সেন ওয়েঙ্গারের পেশাদারি ফুটবল জীবন শুরু হয় ১৯৬৯ সালের দিকে, এ.এস মুটজিগ ক্লাবের মাঝমাঠের খেলোয়াড় হিসেবে। খেলাধুলায় এতো ব্যস্ত থাকার পরেও ওয়েঙ্গার পড়াশোনা বন্ধ করেননি। মুলহাউজে যোগ দেওয়ার আগে কিছুদিন মেডিসিন নিয়ে পড়ার পর, ১৯৭১ সালে তিনি স্ট্রাসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ে পড়তে।

১৯৭৪ সালে এফ.এস.ভি স্ট্রাসবার্গ থেকে তার ডাক আসে। সেখানে তিন বছর তিনি খেলোয়াড়ের পাশাপাশি কোচের সহকারির দায়িত্ব পালন করতেন। সে বছরের নভেম্বর মাসে তিনি মূল দলের হয়ে প্রথমবারের মতো উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের একটি ম্যাচ খেলেন। পরে মোনাকোর বিরুদ্ধে লিগের একটি ম্যাচ খেলার সুযোগ পান। ১৯৭৯ সালে সিনিয়র দলের হয়ে শেষ ম্যাচ খেলেন ওয়েঙ্গার, আরও দুই বছর তিনি স্ট্রাসবার্গের রিজার্ভ টিমের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে ১৯৮১ সালে তিনি প্যারিস থেকে ফুটবল ম্যানেজারদের ডিপ্লোমা পাশ করেন।

 

arsenewenger2

 

পেশাদার ফুটবলার হিসেবে ক্যারিয়ারের ইতি টানার পর ১৯৮৩ সালে তিনি বেশ কিছুদিন এ.এস ক্যানি ক্লাবের সহকারি কোচের দায়িত্ব পালন করেন এবং পরের বছরই প্রধান কোচ পদে উন্নীত হন। প্রথম দুই মরসুমে কোনোরকমে দলকে রেলিগেশন থেকে বাঁচালেও তৃতীয় মরসুমে গিয়ে শেষ রক্ষাটি আর হয়নি। ক্লাবের রেলিগেশনের সঙ্গে ওয়েঙ্গারকেও কোচের পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়।

সে বছরই, অর্থাৎ ১৯৮৭ সালে ওয়েঙ্গার মোনাকো ফুটবল ক্লাব পরিচালনার দায়িত্ব পান এবং ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত তিনি এই ক্লাবের সাথেই যুক্ত ছিলেন। মোনাকোর হয়ে তিনি নিজের সময়কালে একটি লিগ এবং একটি ফ্রেঞ্চ কাপ জেতেন। কোচ হিসেবে নৈপুণ্য দেখানোতে ১৯৯৩ সালে ফ্রান্সের জাতীয় দল থেকে তার কাছে প্রস্তাব আসে প্রধান কোচ হওয়ার। তবে ক্লাবের প্রতি পরিপূর্ণ আনুগত্য দেখিয়ে তিনি সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু যে ক্লাবের জন্যে তিনি এত বড় সুযোগ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, সেই ক্লাবই তাকে হতাশ করে পরের বছরই বরখাস্ত করার মাধ্যমে।

মোনাকো থেকে হতাশাজনকভাবে বরখাস্ত হওয়ার পর ১৯৯৫ সালে জানুয়ারি মাসে ওয়েঙ্গার জাপানের নাগোয়া ফুটবল ক্লাবের ম্যানেজারের দায়িত্ব নেন। সেখানে তিনি মাত্র এক মরসুম কোচিং করান এবং ক্লাবকে জাপানের ‘এমপেরর কাপ’ জেতান। ১৯৯৬ সালে ক্লাব ছাড়ার আগে তাকে ‘বছরের সেরা ম্যানেজার’ উপাধি দেয়া হয়। 

সেই বছরই ওয়েঙ্গারকে আর্সেনাল ফুটবল ক্লাবের কোচ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। তার নামের সাথে ক্লাবের নামের অদ্ভুত মিল অনেককেই অবাক করে। আর্সেনালের মতো বড় ক্লাবের জন্য ইয়োহান ক্রুয়েফের মতো কিংবদন্তীকে উপেক্ষা করে ওয়েঙ্গারের মতো অজ্ঞাত কাউকে কোচ হিসেবে নেওয়ার ব্যাপারটা প্রথম দিকে ক্লাবের সমর্থকেরা সহজভাবে গ্রহণ করেননি, এমনকি দলের অধিনায়কও ওয়েঙ্গারকে নিয়ে সন্দিহান ছিলেন।

 

 

arsenewenger3

 


তবে সে সন্দেহ দূর করতে খুব বেশিদিন সময় নেননি ওয়েঙ্গার। দায়িত্ব নেওয়ার পরের বছরই ওয়েঙ্গার বাজিমাত করেন। একইসঙ্গে লিগ শিরোপা এবং এফএ কাপ জেতান। ওয়েঙ্গার ধীরে ধীরে এমন এক আর্সেনাল দল গঠন করেন যেটির শুধু ম্যাচ জেতার ক্ষমতাই ছিল না, বরং ছিল দৃষ্টিনন্দন খেলার পসরা সাজানোর সক্ষমতা। সেই দলের আদর্শ ছিল টিমওয়ার্ক। তাছাড়া প্রতিভাবান তরুণ খেলোয়াড় চিহ্নিত করার পাশাপাশি সাধারণ মানের খেলোয়াড়কে নির্ভরশীল ও প্রভাবশালী খেলোয়াড়ে রূপান্তর করার ব্যাপারে বিশেষ খ্যাতি তৈরি হয় ওয়েঙ্গারের। যেমন - মোনাকোর দায়িত্বে থাকার সময় তিনি যখন অখ্যাত লাইবেরিয়ান স্ট্রাইকার জর্জ উইয়াহকে সাইন করেন, তখন অনেকেই অবাক হয়েছিলেন। কিন্তু ওয়েঙ্গার ঠিকই তার মধ্যে সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিলেন, যার প্রমাণ হলো উইয়াহর পরবর্তীতে ফিফা বর্ষসেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হওয়া। আর্সেনালে তার অধীনে খেলেই থিয়েরি অঁরি, প্যাট্রিক ভিয়েরা, সেস ফ্যাব্রিগাস, কলু তোরে এবং রবিন ফন পার্সিরা বিশ্বমানের তারকায় পরিণত হয়েছিলেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই মিডিয়া তাকে ‘দ্য প্রফেসর’ নামে সম্বোধন করতে শুরু করেছিল।

অর্থনীতিতে ডিগ্রীধারী ওয়েঙ্গার ছিলেন একজন সুকৌশলী অর্থনীতিবিদ। সুলভ মূল্যে খেলোয়াড় কিনে তাকে মোটামুটি উচ্চতর মূল্যে অন্য ক্লাবে বিক্রি করায় তার জুড়ি ছিল না। এর সবচেয়ে সুস্পষ্ট উদাহরণ হচ্ছেন ফরাসি খেলোয়াড় নিকোলাস আনেলকা। তাকে মাত্র ৫ লাখ পাউন্ড দিয়ে প্যারিস সেইন্ট জার্মেই থেকে কিনে ঠিক দু’বছর পরে রিয়াল মাদ্রিদের কাছে ২২.৩ মিলিয়ন পাউন্ড দরে বিক্রি করেন ওয়েঙ্গার। ওয়েঙ্গারের পিঠে স্নাইপারের সাইনবোর্ড লাগে যখন থিয়েরি অঁরি, রবার্ট পাইরেস এবং সিলভেন উইল্টোর্ডকে দলে ভেড়ান তিনি। এই তিনজন খেলোয়াড়ই ২০০৩-০৪ সালে আর্সেনালকে প্রিমিয়ার লিগ জেতাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।


এমনকি তার দায়িত্বাধীনে আর্সেনাল দল ২০০৩-০৪ সিজনের শিরোপা জেতে কোনো ম্যাচে না হেরেই, যার জন্য সেই সিজনের আর্সেনাল দলকে ‘ইনভিন্সিবল’ খেতাব দেওয়া হয়। তবে ঝামেলা বাঁধে পরের সিজন থেকেই। ২০০৪ সালের সেই সিজনের পর থেকে টানা প্রায় ১২ বছর সমর্থকদের শিরোপার মুখ দেখাতে পারেননি ওয়েঙ্গার। কিন্তু তারপরও তার উপর পুরোপুরি ভরসা হারায়নি ম্যানেজমেন্ট থেকে শুরু করে দর্শকরাও। তবে একদমই যে কথা উঠেনি, তা নয়। তাকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে যেমন অনেকেই সমালোচনা করেছেন, মাঝেমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে তার খেলানোর ধরন নিয়েও। তবু ওয়েঙ্গার শক্ত হাতে ধরে ছিলেন আর্সেনাল দলের হাল। পরে ২০১৩-১৪ সিজনে তিনি ১২ বছর পর আবার এফ.এ কাপ শিরোপা জেতেন এবং পরের সিজনের শুরুতেই জিতে নেন এফ.এ কমিউনিটি শিল্ড কাপ।


একজন বিদেশি ম্যানেজার হিসেবে প্রায় দুই দশক ধরে আর্সেনালের সাথে যুক্ত থাকা ওয়েঙ্গার জিতেছেন ১৭টি শিরোপা, দলের জন্যে তৈরি করেছেন নতুন একটি স্টেডিয়াম। পেশাদার ফুটবলার হিসেবে ওয়েঙ্গারের অর্জন নেই বললেই চলে। তবে ম্যানেজার হিসেবে তিনি এর তুলনায় অনেক বেশিই সফল।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...