'জমিদার মশাই' নন, তিনি 'বাবুমশাই'

জোড়া সাঁকো ঠাকুর পরিবারের জমিদারী ছিল বাংলাদেশ এর ওড়িশার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর এই বিশাল জমিদারি ক্রয় করেন।
নদিয়া জেলার কুষ্টিয়া, শিলাইদহ, পাবনা জেলার শাহজাদপুর পরগণা, রাজশাহী জেলার কালীগ্রাম। এছাড়া পাবনার পত্তনী তালুক তরফ চাপড়ি, রংপুরের স্বরুপপুর এবং যশোরের মোহাম্মদশাহীতে জমিদারী ছিল।দ্বারকা নাথের মৃত্যুর পর দেবেন্দ্রনাথ জমিদারী রক্ষার প্ৰধান পুরুষ হয়ে ওঠেন। কিন্তু তিনি বিষয়ের জটিলতায় যাওয়ার বদলে জমিদারী অঞ্চলকে সুষ্ঠ ও সুসংহত করার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। তাঁর পুত্রদের জমিদারি সামলাবার দায়িত্ব দেন। শিলাইদহ এবং কুষ্টিয়ার দায়িত্বে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

কলকাতার অভিজাত রাজপুরুষটি যেন সেই সূত্রেই অনেকটা নেমে আসেন মাটির কাছাকাছি। মাটির জীবনকে দেখেন সামনে থেকে। কুষ্টিয়া- শিলাইদহ অঞ্চলে তাঁদের বড় বড় বাড়ি ছিল। কিন্তু তিনি থাকতেন বোট হাউসে। নদীতে ভেসে কাটিয়েছেন দিনের পর দিন। প্রকৃতির যতটা কাছাকাছি থাকা যায় তার চেষ্টা করেছেন। ভাসমান এই জীবন তাঁর খুব প্রিয় চল। বহু সৃষ্টির সঙ্গী। বহু লেখায় উঠে এসেছে বোট যাপনের কথা। ছিন্ন পত্রের এক জায়গায় লিখেছেন, " কাছারির পর পারের নির্জন চরে বোট লাগিয়ে বেশ আরাম হচ্ছে। দিনটা ও চারিদিকটা এমনি সুন্দর ঠেকছে সে আর কী বলব। অনেকদিন পরে আবার এই বুড়ো পৃথিবীটার সঙ্গে যেন দেখা সাক্ষাৎ হ'ল। সে ও বললে 'এই-যে'। আমিও বললুম ' এই-যে'।
বোট থেকে সাধারণ মানুষের প্রতি দিনের বেঁচে থাকা দেখতেন। নদীর জলে জেলের মাছ ধরা, ছেলেদের দাপাদাপি, জল- যাতায়াত, রোদ, আলো, বাতাস সবই ঘিরে ছিল তাঁকে। এমনি করে দিনের পর দিন থাকতে থাকতে মানুষও নিজের করে নিয়েছিল তাঁকে।

অথচ তখনও রাজা-প্রজার সম্পর্ক ভয়ের ইঁট দিয়ে গাঁথা। তাতে ফাটল ধরানো সহজ ছিল না। মানুষ মানলেও সমাজ বড় কঠিন ঠাঁই। পেয়াদা, দারোয়ান, নায়েব, গোমস্তা পেরিয়ে তবে দেখা মিলত রাজার। জমিদারি সামলাতে গিয়ে এমন বেশ কিছু নিয়মের রাশ আলগা করেছিলেন তিনি। প্রজাদের কাছে হয়ে উঠেছিলেন 'বাবুমশাই'। শচীন্দ্র নাথ অধিকারী এমনই একটি গল্প বলেছেন।দিনটা ছিল পুণ্যাহ। জমিদারি সেরাস্তায় খাজনা দেওয়ার বছরের প্রথম দিন। ঠাকুরবাড়ির জমিদারিতে তিন দিন ধরে পালন করা হত এই উৎসব। পালাগান, যাত্রা, প্রজাদের ভোজ নানারকম ছিল সেই উৎসবের অঙ্গ। কবি সেবার প্রথম শিলাইদহ কাচারীর পুণ্যাহ উৎসবে এলেন। দেখেন কাছারি ঘরে একটা সিংহাসন রাখা। বাকি সব আলাদা আলাদা আসন।বড়লোক- গরিব লোক, হিন্দু মুসলিম আবার বর্ণ অনুযায়ী আসনের ভাগও ছিল। কবি কাউকে কিছু বিশেষ বললেন না। যথা সময়ে বাজনা বাদ্যি বাজিয়ে 'নতুন জমিদার' এলেন। কিন্তু কিছুতেই সিংহাসনে বসলেন না তিনি। সমানে দাঁড়িয়ে। হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। ব্যাপার কী! কী ত্রুটি হয়েছে?!
তিনি জানালেন, মানুষে মানুষে আসনের এই তফাৎ বন্ধ করতে হবে!
আমলা, নায়েব, গোমস্তা কেউ রাজি হল না এই প্রস্তাব মানতে। বংশ পরম্পরায় চলে আসা প্রথা তা কি এক কথায় বাতিল করা যায়! অনেকে জমিদারের চাকরি ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মানতে হল সকলকে জমিদারের কথাই।গ্রামের সব প্রজা, গোমস্তা, নায়েব এবং জমিদার মশাই সকলে মিলে বসলেন একটা মস্ত জাজিমের ওপর। শুরু হল পুণ্যাহের কাজ। সকলেই বুঝল ঠাকুরবাড়ির জমিদারিতে এবার নতুন কালের সূর্য দেখা দিল। এবার বদল আসবে!

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...