কাল শব্দটির সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। সেই কাল বা সময়ের স্ত্রীলিঙ্গ রূপে কালী শব্দটি প্রচলিত।কাল অর্থে শিবকে নির্দিষ্ট করা হয়। তিনি আদি প্রাচীন বিরাট বিশাল। সেই অর্থে মহাকালও বলা হয় পুরুষের উপর স্ত্রী শক্তি। শিবের উপর কালীর বাস। কাল ও কালী পাশাপাশি সহাবস্থানে থেকে শক্তির প্রতীক হয়ে উঠেছে। যখন শিব পার্বতীকে কালী বলে সম্বোধন করেন তখন তিনি অত্যন্ত রেগে যান। পার্বতী তার কালবর্ণ হারানোর জন্য তপস্যা করেন এবং গৌরী হন সোনালী।
তন্ত্র পুরাণে দেবী কালীর একাধিক রূপভেদের উল্লেখ পাওয়া যায়। তোড়লতন্ত্র অনুসারে, কালী নয় প্রকার। যথা: দক্ষিণা কালী, কৃষ্ণ কালী, সিদ্ধ কালী, গুহ্য কালী, শ্রী কালী, ভদ্রকালী, চামুণ্ডা কালী, শ্মশান কালী ও মহাকালী।
মহাকাল সংহিতার অনুস্মৃতিপ্রকরণে নয় প্রকার কালীর উল্লেখ পাওয়া যায়। যথা- দক্ষিণাকালী, ভদ্রকালী, শ্মশানকালী, কালকালী, গুহ্যকালী, কামকলাকালী, ধনকালী, সিদ্ধিকালী, চণ্ডিকালীকা।
সেই অর্থে দেখা যায় প্রায় সমস্ত পুরাণেই প্রামাণ্য তথ্য হিসাবে কালীর রূপ হিসাবে গুহ্য কালীর নিদর্শন পাওয়া যায়। গুহ্য কালী বা আকালী, দেবী কালীর একটি বিশেষ রূপ। দেবীভাগবত পুরাণ মতে, তিনি দেবী শতাক্ষীর শরীর থেকে উৎপন্না অন্যতমা মহাশক্তি। কোনও কোনও সাধক এই রূপে কালীর আরাধনা করে থাকেন, তবে গৃহস্থের নিকট এই রূপ অপ্রকাশ্য। গুহ্যকালী কালীর এক অতি ভয়ংকরী রূপ। এই রূপ কালীর প্রচলিত রূপের চেয়ে অনেকটাই পৃথক। গুহ্যকালীর দুই হাতে থাকে সাপ ও খড়গ। গুহ্যকালীর গাত্রবর্ণ গাঢ় মেঘের মত, তিনি লোলজিহ্বা গলায় পঞ্চাশটি নরমুণ্ডের মালা, কটিতে ক্ষুদ্র কৃষ্ণবস্ত্র, কাঁধে নাগবেষ্টিত উপবীত, মাথায় জটা ও অর্ধচন্দ্র, কানে শবদেহরূপী অলংকার, হাস্যযুক্তা, চতুর্দিকে নাগফণা দ্বারা বেষ্টিতা ও নাগাসনে উপবিষ্টা, বামকঙ্কণে তক্ষক সর্পরাজ ও দক্ষিণকঙ্কণে অনন্ত নাগরাজ, বামে বৎসরূপী শিব, তিনি নবরত্নভূষিতা, নারদ সহ আদি ঋষিগণ শিবমোহিনী গুহ্যকালীর সেবা করেন, তিনি সর্বদায় অট্টহাস্যকারিণী, মহাভীমা ও সাধকের কাছে তিনি ভাল ফল প্রদান করেন। গুহ্যকালী নিয়মিত শবমাংস ভক্ষণ করে থাকেন। আসলে কালী মাতার সৃষ্টির ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে দেখা যায় তিনি বিশ্ব ব্রহ্মান্ড জুড়েই বিরাজিত।
প্রামাণ্য তথ্য হিসাবে দেখা যায়- ইউরোপে জিপসিরা নাকি এক কৃষ্ণবর্ণা দেবীর পুজো করতেন। যার পোশাকি নাম 'ক্যালিয়াস'। এশিয়াতেও প্রাচীনকালে এক কালো দেবী বিরাজ করতেন। যার নাম ছিল কাইবেল। একটি শহরও ছিল তাঁর নামে, 'কালীপোলিস'। পরবর্তীকালে এই শহরই হয়তো নাম পাল্টে হয়েছিল 'ক্যালিপোলি'। শোনা যায়, ফিনল্যান্ডেও এক কৃষ্ণাঙ্গ দেবীর পুজো চালু ছিল। যার নাম 'কালমা'। মিশরীয় সভ্যতায় ফারাওরা নানা দেবদেবী পুজো করতেন। তার মধ্যে কালো রঙের এক নারীমূর্তির পুজোও প্রচলিত ছিল। নাম, 'কালীম্রাতস'। রোমে যুদ্ধের দেবী ছিলেন 'বেলোনা'। অনেকটা মা কালীর মতো। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতায় চতুর্ভুজা কালো পাথরের এক দেবীমূর্তি পাওয়া যায়। রামায়ণে মহীরাবণ বধের মুহূর্তে নিকষ কালো এক ভয়ঙ্কর দর্শনা দেবীর আবির্ভাব ঘটেছিল। যিনি বর্তমানে শ্রীলঙ্কা এবং দক্ষিণ ভারতে কৃষ্ণাম্মাকালী নামে কোথাও কোথাও পুজো পান। মহাভারত, সেখানেও অন্য রূপে কালীর দেখা মিলে। শবর, যাদব এই সব আদি ভারতীয় প্রজাতির মধ্যে এক কৃষ্ণবর্ণা দেবীর ইতিহাস পাওয়া যায়। বাইবেলের বুক অফ হিব্রুতে এক কালো দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে গুহ্য কালীর মতো ভয়ঙ্করী কালী নেই। তিনি কালীর প্রচন্ড উগ্র রূপ সেই কারণে গৃহস্থরা এই কালীকে পুজো করতে পারেন না।
তাঁর জন্ম ইতিহাস সম্পর্কে পুরানে কথিত আছে- দারুক নামে এক অসুরকে বধ করেছিলেন এক দেবতা। তারপর তিনি মহেশ্বরের শরীরে প্রবেশ করেন এবং নীলকণ্ঠ মহেশ্বরের গলার বিষের রঙে তিনি কালো রং ধারণ করেন। তাই তিনি বিষধরী, উগ্রচন্ডা, ভীষণ ভয়ঙ্করী। তাঁর সাধনা করা খুব কঠিন , জানা যায় বামদেব এই দেবীর সাধনা করতেন। তাঁর সাধনায় সিদ্ধিলাভ করা খুব জটিল। এই দেবীর পীঠস্থান বাংলায় কমেই আছে। তাঁর পূজাচর্নার জন্য মন্দিরও ভীষণ রহস্যময়ী।
বীরভূম জেলার আকালীপুর গ্রামে ব্রাহ্মণী নদীর তীরে শ্মশানের পাশে মহারাজা নন্দকুমার একটি গুহ্যকালী মন্দির নির্মাণ করেন। তবে এই বিচিত্র কালীমূর্তিটি তাঁর দ্বারা নির্মিত হয়নি। জনশ্রুতি, পৌরাণিক মগধরাজ জরাসন্ধ এই মূর্তিটি নির্মাণ করেছিলেন। কালক্রমে বিভিন্ন রাজার হাতে পূজিত হওয়ার পর কাশীরাজ চৈত সিংহের রাজ্যের এক কৃষক তার জমিতে মূর্তিটি খুঁজে পান।পূজার্চনা শুরু করেন। তবে এই সময় ওয়ারেন হেস্টিংসের নজরে পড়ে যায় মায়ের এই অপরূপ মূর্তি। ওয়ারেন হেস্টিংস সেই সময় কাশীতেই ছিলেন, মায়ের কারুকার্যমন্ডিত অপরূপ মূর্তি দেখে তার লোভ হয়। আর তিনি মায়ের এই মূর্তিটিকে ইংল্যান্ডের মিউজিয়ামে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করতে শুরু করেন। তার এই গোপন পরিকল্পনার কথা জানতে পেরে যান চৈত সিং। তিনি তখন মায়ের মূর্তিটিকে গঙ্গাবক্ষে লুকিয়ে রাখেন। আর তিনি রটিয়ে দেন যে মূর্তি চুরি গিয়েছে।
অপরদিকে মহারাজ নন্দকুমার মাকে প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্নাদেশ পেয়ে কাশী যাত্রা করেন আর তিনি চৈত সিংকে সব খুলে বলেন। চৈত সিং সব শুনে তো হাতের কাছে চাঁদ পেলেন। তিনি সানন্দে নৌকা করে নন্দকুমারের সঙ্গে মূর্তি পাঠিয়ে দিলেন। নন্দকুমার সেই মূর্তি নিয়ে দ্বারকা ব্রাহ্মণী নদী পার করে। চলে এলেন আকালীপুরে। এখানে এসে ব্রাহ্মণী নদী তীরে শ্মশানের পাশে নিরিবিলি স্থানে আছে মায়ের আটকোনা ইটের মন্দির। সর্বসাধারণের কাছে এই মন্দিরের নির্মাণ বড় সাদামাটা মনে হলেও তন্ত্র সম্মতভাবে সাধনার উপযোগী স্থানে এই মন্দির নির্মিত হয়েছে।
প্রসঙ্গত, নন্দকুমারের অসংখ্য প্রজাদরদী কাজের জন্য ওয়ারেন হেস্টিংস একসময় তার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন ও তার বিরুদ্ধে গোপন ষড়যন্ত্র শুরু করেন। পরবর্তীকালে ওয়ারেন হেস্টিংস মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করেন নন্দকুমারকে ও বিচারে তার ফাঁসি হয়। কথিত আছে নন্দ কুমারের ফাঁসির সময় মন্দিরের চূড়াটি ফেটে যায়। সেই সময় থেকে শুরু করে আজও নন্দকুমারের বংশধররা মায়ের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে বহাল রয়েছেন।
মন্দিরের দক্ষিণে "পঞ্চমুণ্ডী" নামে পরিচিত একটি সিদ্ধাসন রয়েছে। যেখানে বসে সাধক পুরুষরা তাদের তন্ত্র মন্ত্র বলে সিদ্ধিলাভ করেন। আকালীপুরের দেবী গুহ্যকালীকে ভক্তেরা দেবীকে অতিশয় জাগ্রত দেবী মনে করেন। দূর-দূরান্ত থেকে পুণ্যার্থীরা এই মন্দিরে মানসিক করে। দেবী গুহ্য কালীর বিশেষ গোপনীয়তা বজায় রেখেই সমস্ত আচার পালন করা হয়।