ষষ্ঠী দেবীর আখ্যান

হিন্দু সমাজের অন্যতম এক উৎসব হল এই ষষ্ঠী পুজো । স্কন্দ পুরাণ অনুসারে দেবী ষষ্ঠী হলেন কার্তিকের স্ত্রী। তিনি ব্রহ্মার মানস কন্যা, নাম দেবসেনা। মাতৃকার মধ্যে প্রধানা, প্রকৃতির ষষ্ঠাংশ রূপা। আবার মতান্তরে দেবী ষষ্ঠী হলেন দূর্গার একটি ভিন্ন রূপ অর্থাৎ কার্তিকের জননী বা কাত্যায়নী।ইহা ব্যতীত মহাভারতে মগধরাজ বৃহদ্রথের পুত্র জরাসন্ধের বিবরণে জানা যায়— জরা রাক্ষসীর নামান্তর ব্রহ্মা কতৃক সৃষ্ট। ইনি গৃহস্থের গৃহে গৃহে গমন করতেন বলে ব্রহ্মা এর নাম রাখেন 'গৃহদেবী'। মহাভারতের আদিপর্বে উল্লেখ করা হয়েছে "যে ব্যক্তি যৌবনসম্পনা সপুত্রা মূর্তি গৃহে রাখে, তার গৃহ সর্বদা ধনধান্য, পুত্রকন্যাদিতে পূর্ণ থাকে।" ইনি ষষ্ঠী দেবী। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুযায়ী স্বয়ম্ভূব মনুর পুত্র প্রিয়ব্রত নামে এক রাজা ছিলেন। বহু বছর নিঃসন্তান থাকার পর ব্রহ্মার আদেশে কশ্যপ ঋষির সাহায্যে পুত্রষ্টি যজ্ঞ করলেন। কিন্তু রাজমহিষী মৃত পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। রাজা তাকে নিয়ে শ্মশানে এলে ষষ্ঠী দেবী আবির্ভূতা হলেন এবং মৃত পুত্রকে তপস্যা দ্বারা পুনর্জীবিত করে সঙ্গে নিয়ে যেতে উদ্যত হলেন। রাজা তখন দেবীকে স্তব করে তুষ্ট করলেন। দেবী বললেন রাজা স্বয়ং তাঁর  পুজো র অনুষ্ঠান করলে এবং সমগ্র রাজ্যে এই  পুজো র প্রচলন করলে পুত্রকে তিনি প্রত্যার্পণ করবেন। রাজা দেবীর কথায় স্বীকৃত হয়ে ষষ্ঠী  পুজো  করলেন এবং সমগ্র রাজ্যে প্রতি মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে দেবী  পুজো র আদেশ দিলেন।

এইভাবেই লোকসমাজে ষষ্ঠী দেবীর ব্রত পালন হয়ে আসছে। ষষ্ঠী দেবী সর্বত্র লৌকিক দেবী হিসাবে পূজিত আদি মাতৃ পুজো র একটি অংশ হিসাবে ষষ্ঠী  পুজো কে ধরা হয়। গবেষকদের মতে মানব গৃহ্যসূত্রের সম্ভাব্য সংকলন-কাল খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ বা পঞ্চম শতকেরও আগে। অর্থাৎ বৈদিক বা শ্রৌত পদ্ধতিতে দেবী ষষ্ঠীর উপাসনা এ দেশে প্রায় আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন। কালের নিয়মে এই  পুজো র রীতিনীতিতে অজস্র বদল এসেছে, এবং বর্তমানে বাংলার নারীসমাজে প্রচলিত ষষ্ঠী-উপাসনা বিধি তেমনই এক সুপ্রাচীন বৈদিক সংস্কৃতির অনুবর্তন, কোনওভাবেই তা অর্বাচীন বা লৌকিক কোনো অভ্যাস মাত্র নয়৷ বৈদিক সাহিত্যে যা ছিল 'ষষ্ঠীকল্প', বাংলার নারীসমাজে তাই হয়েছে 'ষষ্ঠীব্রত'।

গোটা বছর জুড়ে ষষ্ঠী দেবীর  পুজো  বা ব্রতের প্রচলন আছে। বৈশাখ মাসের ষষ্ঠী কে বলা হয় শুক্লাষষ্ঠী। সন্তানকে ধুলাবালি তথা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ থেকে নিরোগ রাখার জন্য এই ব্রত পালন করা হয়।

জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লাষষ্ঠীকে অরণ্য ষষ্ঠী বলে। এই ষষ্ঠীতে  স্ত্রীলোকেরা তালপাতার পাখা ও অন্যান্য  পুজো র সামগ্রী নিয়ে বনে গিয়ে অরণ্য ষষ্ঠী দেবীকে  পুজো  করেন। যদিও এই ষষ্ঠী এখন জামাই ষষ্ঠী রূপেই অধিক প্রচলিত। বলা যায় সবচেয়ে জনপ্রিয় ষষ্ঠীব্রত রূপেই বঙ্গ সমাজে বিদ্যমান। শাশুড়ি মা তার জামাই কে ডেকে নিজে অভুক্ত থেকে জামাইকে ভাল ভাল খাবার রেঁধে খাওয়ান। মেয়েকে ভালো রাখার চাবিকাঠিটি তিনি খুঁটে বেঁধে রাখতে চান। ষষ্ঠী  পুজো র এও এক আখ্যান।

আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী। সন্তান কামনার জন্য পালন করা হয় এই ষষ্ঠীব্রত। এই ষষ্ঠীব্রতকে বিপত্তারিণী ব্রত বলা হয়। এই দিন মায়েরা দেবী ষষ্ঠীকে তেরোটি ফুল, তেরোটি ফল, তেরোটি পান, তেরোটি সুপারি, তেরোটি দূর্বা দিয়ে  পুজো  করেন।

সন্তানের অকাল মৃত্যু রোধে শ্রাবণ মাসের শুক্লাষষ্ঠীতে পালিত হয় লুন্ঠন ষষ্ঠী বা লোটন ষষ্ঠী। এই দিন মায়েরা তালের লেই, চালের গুড়ো বা আটা দিয়ে মেখে তেলে ভেজে দেবী ষষ্ঠীকে নৈবেদ্য দেন।

ভাদ্র মাসের শুক্লাষষ্ঠীতে সন্তানের ধনলাভের কামনায় মন্থন ষষ্ঠী বা মাথানী ষষ্ঠী পালিত হয়। একে অক্ষয় ষষ্ঠী বা চাপড়া ষষ্ঠীও বলা হয়। মায়েরা চাপড়া পিঠে করে দেবী ষষ্ঠীকে পুজো দেন। পুজো শেষে নৌকা জলে ভাসিয়ে দেন ব্রতিনীরা এবং মুখে বলতে থাকেন— “চাপড়া যায় ভেসে, ছেলে থাকুক বেঁচে।”

আশ্বিন মাসের শুক্লাষষ্ঠীতে পালিত হয় দুর্গাষষ্ঠী বা বোধন ষষ্ঠী। নারীদের বিশ্বাস যে আদ্যাশক্তি দুর্গাও এদিন সন্তান কামনা করেছিলেন। ফল, ফুল, দূর্বা, মিষ্টান্ন, আতপ চালের নৈবেদ্য, ধূপ, দীপ ইত্যাদি দিয়ে এই ব্রত করা হয়।

কার্তিক মাসের শুক্লাষষ্ঠীতে পালিত হয় নাড়ীষষ্ঠী। রাখাল বালকদের মায়েরা এদিন পালন করেন গোঠ ষষ্ঠী এই কামনায় যাতে তাদের সন্তানরা হাটে—মাঠে-ঘাটে থাকাকালীন ভাল থাকে। অবাঙালিরা এদিন ছট্ পুজো করে থাকেন।

অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লাষষ্ঠীকে গুহ ষষ্ঠী বলে। ইহাকে মূলকরূপিণীষষ্ঠী বা মূলাষষ্ঠীও বলা হয়। পৌষ মাসের শুক্লাষষ্ঠী অন্নরূপাষষ্ঠী বা অন্নষষ্ঠী নামে পরিচিত। প্রাচীন কৃষিলক্ষ্মীর সহিত অন্নষষ্ঠীর সম্বন্ধ আছে। মায়েরা এদিন পিঠে-পায়েস করে ষষ্ঠী দেবীকে পুজো করেন।

শ্রীপঞ্চমী বা সরস্বতী পুজোর পরের দিন হয় শীতলষষ্ঠী ব্রত। এই ব্রতে মায়েরা সব কিছু শীতল বা ঠান্ডা খান কিংবা গোটা সেদ্ধ খান। অনেক জায়গায় পান্তাভাত খাওয়ার চল আছে। এই ব্রতের ফলে সংসার শোকতাপ মুক্ত থাকে। ফাল্গুন মাসের ষষ্ঠীকে বলা হয় শুক্লা ষষ্ঠী গোরূপিণীষষ্ঠী।

চৈত্র মাসের শুক্লাষষ্ঠীকে স্কন্দষষ্ঠী বলা হয়। এদিন কার্তিকের পুজো করলে ব্রতকারীদের সুখ সৌভাগ্য ও পরকালে বৈকুণ্ঠ প্রাপ্তি হয়। এই মাসে নীল ষষ্ঠীর ব্রতও পালন করা হয়।

বারো মাস জুড়ে ষষ্ঠী ব্রত পালন করা ছাড়াও দুটি ব্রত খুব প্রচলিত তা হল শিশুর জন্মের পর ষষ্ঠ দিনে 'সূতিকাষষ্ঠী' বা 'ঘাটষষ্ঠী' এবং একবিংশ দিনে 'একুশে' বা 'শুদ্ধষষ্ঠী'। এই দুটি ষষ্ঠী সন্তানের মঙ্গল কামনায় মায়েরা খুব নিষ্ঠা ভরে পালন করে থাকে।

নবজাতক জন্মগ্রহণের ছয় দিনের মাথায় বাড়িতেই পুজো হয় দেবী ষষ্ঠীর। তা হল 'ষাটষষ্ঠী' বা 'ষেটেরা'। অর্থাৎ বংশবৃদ্ধি বা জনজীবনকে সচল রাখার স্বার্থেই জড়িয়ে ষষ্ঠী পুজোর চল। অর্থাৎ ষষ্ঠীদেবী হলেন প্রজননের দেবী। মানুষের বংশধর টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে শরণাপন্ন হতে হয় এই ষষ্ঠীদেবীর কাছে। লোকসমাজে প্রচলিত ধারণা রয়েছে যে- ষষ্ঠীদেবীর কৃপায় নিঃসন্তান মহিলা সন্তানের উৎপাদন করতে সক্ষম হয়। এই ষষ্ঠীদেবীই হয়ে ওঠেন মঙ্গল এবং রক্ষার দেবী। আবার শিশু জন্মের ২১তম দিনেও ষষ্ঠী পুজো করা হয়। নবজাতকের জন্মের ছয় দিনের দিন মূলতঃ পুজো করা হয়।

এদিন বাড়ির দেওয়ালে তৈরি করতে হয় 'ষষ্ঠীর ঘর"। অনেক যায়গায় বলা হয় ‘কৌড়ির ঘর’। মাটি দিয়ে সেই ঘরটি বানানো হয়। তবে পাকাবাড়ির দেওয়ালে আজকাল আর 'ষষ্ঠীর ঘর' বানানো হয় না। যেখানে মাটির দেওয়ালেই আছে সেখানে একটি ছবি অঙ্কন করে পুজো করা হয়। সাধারণত নবজাতকের আয়ু বাড়ানোর লক্ষ্যেই এই 'ষষ্ঠীর ঘর' বানানো হয়। নবজাতকের জন্ম থেকে তার জীবনে কী আছে না আছে সবেই যেন দেবী ষষ্ঠীর কৃপায় লিখিত হয়, বিধাতাকে দিয়ে দেবী অলক্ষ্যে লিখিয়ে নেন নবাগতর আগত ভবিষৎ। এরকমই ধারণা পোষণ করেন সমাজের অনেক মানুষজন। সেই কারণে জনমানসে আজও ষষ্ঠী দেবীর ব্রত পালনের ধুম লক্ষ্য করা যায়।

দেখতে পাচ্ছি লৌকিক ধর্মে ষষ্ঠীর যথেষ্ট প্রাধান্য। এর উদ্ভব পুরাণে এবং অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালের পুরাণে, অর্থাৎ এখন থেকে বারো তেরোশো বছর আগেকার পুরাণে। এর আগে ষষ্ঠী তেমনভাবে না থাকলেও ষটকৃত্তিকা ছিল, যাদের স্তন্যপান করে বাঁচতে হয়েছিল বলেই কার্তিকের ছটি মুখ—ষম্মুখ হন তিনি। এই ছয় কৃত্তিকা কেমন করে ষষ্ঠীতে পরিণত হন তা বোঝা যায় না,জাতকের জন্মের ষষ্ঠ দিনে যিনি এসে তাকে আশীর্বাদ করেন তিনিই ষষ্ঠী। কিন্তু কৃত্তিকারা নেহাত গৌণ দেবী ছিলেন— এঁদের নাম ছিল দুলা, নিতত্নী, চুপুণিকা, অভয়ন্তী, মেঘয়ন্তী, বর্ষয়ন্তী।

তবে ষষ্ঠী দেবীর প্রতিনিধি রূপ এই কৃত্তিকারা ছেলে বা মেয়ের আশীর্বাদস্বরূপা হয়ে  ধরা দেন, যদিও নবজাতক যদি ছেলে হয় সেক্ষেত্রে ষষ্ঠীপুজোর আগ্রহ বাড়ে। মেয়ে হলে সেরকম গুরুত্ব পায় না। এ তো আমাদের সমাজের বহুদিনেরই নিয়ম, সেই কারণে এখনও ভ্রূণ হত্যার মতো ঘটনা ঘটে। তবে ষষ্ঠী পুজোর নিয়মে ষষ্ঠী দেবীর ঘরটি বেশ আকর্ষণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমে দেওয়ালের গায়ে নক্সা করে কাদামাটি দিয়ে উঁচু এবং মোটা করা হয়। প্রথমে বর্গক্ষেত্র বা আয়তক্ষেত্র বানানো হয়। এরপর তার চার কোণে বাইরের দিক থেকে চারটি অর্ধচন্দ্র তৈরি করা হয়। বর্গক্ষেত্রের উপরের বাহুর উপরের দিকে তিনটি পদ্মফুলের পাঁপড়ি বানানো হয়। পাপড়ি তিনটি পরস্পরের সঙ্গে জোড়া থাকে, একে বলে পদ্ম চূড়া। বর্গক্ষেত্রের দুধারের দুই বাহুর দুপাশে দুটি অর্ধ গোলাকার তৈরি করা হয়। একে বলে 'চক্ষুদান'। বর্গক্ষেত্রের মধ্যে বানানো হয় অতি পরিচিত 'স্বস্তিকা চিহ্ন'। স্বস্তিকার ওপর দুটি গোলাকার কাদার মন্ড বানানো হয়। এতে আটকানো থাকে 'কড়ি'। অর্ধচন্দ্রগুলির মাঝেও কড়ি আটকানো থাকে চারটি। তবে কোথাও কোথাও ষষ্ঠী দেবীর মূর্তি পুজোর প্রচলনও আছে। দেবীকে দ্বিভুজা বা চতুর্ভুজা রূপে দেখা যায়। তাঁর কোলে থাকে শিশু সন্তান। ষষ্ঠীদেবীর পুজো সাধারণত বটগাছতলায়, বাড়ির আঙিনায়, নদী বা পুকুরের ধারে হয়ে থাকে। অনেক গ্রামে বট-অশ্বত্থ বৃক্ষমূলে 'ষষ্ঠীতলা' বলে নির্দিষ্ট স্থানে বিভিন্ন ষষ্ঠীদেবী নির্দিষ্ট তিথিতে পূজিতা হন। মূলত গৃহস্থ নারীরা তেল-হলুদ-দই, ঘট, বটের ডাল ইত্যাদি উপকরণের মাধ্যমে পুজো নির্বাহ করে থাকেন, পুজো শেষে 'ব্রতকথা' শ্রবণ করে স্নান সেরে বাড়ি ফিরে ফলাহার করেন।বটতলাই হল ষষ্ঠীর আটন।এই কারণে তাকে বটবিটপবিলাসী বলা হয়েছে।বর্ণহিন্দু নবশাখ গোষ্ঠীর মহিলারা ষষ্ঠীর ব্রত করলেও তথাকথিত অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের রমণীরা শুধুমাত্র অরণ্য ও শীতলা ষষ্ঠী ব্রত পালন করেন।

বাঁকুড়ার পাঁচমুড়ো কিংবা সোনামুখিতে স্থানীয় কুম্ভকারেরা এক ধরনের মাটির পুতুল তৈরী করেন।নাম ষষ্ঠীপুতুল বা যো পুতুল।এগুলি ষষ্ঠীতলায় মানত হিসাবে দেওয়া হয়।পুতুলগুলি স্রেফ আঙুল টিপে তৈরি। ষষ্ঠীর কোলে এক বা দুই কিম্বা দশের অধিক শিশু থাকে। মঙ্গল-কাব্য এবং বাঙালি লোক কাহিনী‍গুলোতে তাকে মনসার ঘনিষ্ঠ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। বিভিন্ন মতামত উঠে আসে কেও মনে করেন দেবীর আবির্ভাব বহুকাল আগেই, দেবী দুর্গার সঙ্গে একাসনেই বসাতে চান অনেকেই, আবার কিছু জন মনে করেন তিনি বাংলার লৌকিক দেব-দেবীর সঙ্গে সমানভাবেই আরাধ্য। এখনও তাঁকে নিয়ে কত চড়া প্রচলিত- "যেমন ঠাকুরের তেমন পুজো / ষষ্ঠী ঠাকুরের খই ভাজা"।

 

 

নিবন্ধকার ঃ রাহুল কর

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...