ভগবান মহাদেবের বিচারে পৃথিবীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ তীর্থ কোনটি?

ভবিষ্য পুরাণ অনুযায়ী, শৌণকাদি মুনিগণ একাধিক প্রশ্ন করেন ও মহামুনি লোমহর্ষণ তার যথাযথ উত্তর দেন। একবার শৌণকাদি মুনিগণ মহামুনি লোমহর্ষণকে জিজ্ঞেস করলেন, পৃথিবীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ তীর্থ কোনটি? কোন তীর্থ লাভ করলে সর্বজ্ঞানপ্রাপ্ত হওয়া যায়? তখন মহামুনি লোমহর্ষণ তার উত্তরে পাণিনির রুদ্র সাধনা ও বর লাভের কথা বললেন। ভবিষ্য পুরাণ অনুযায়ী শৌণক প্রমুখ প্রাচীন মুনিগণ লোমহর্ষণকে যখন জিজ্ঞেস করলেন, আপনি হচ্ছেন মহাজ্ঞানী, আপনি ত্রিকালদর্শী ব্যাসদেবের শিষ্য। এই পৃথিবীতে আপনার অজানা কিছুই নেই। আপনি বলুন তো পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ তীর্থ কোনটি?

লোমহর্ষণ তখন এই প্রশ্নের উত্তরে বললেন, আপনারা যা বললেন সব কথা সত্যি। সত্যি এই পৃথিবীতে তীর্থক্ষেত্রের কোনও অভাব নেই কিন্তু সমস্ত তীর্থের মধ্যে কোনটি সেরা তীর্থক্ষেত্র সে বিচার করা খুবই কঠিন। এ বিষয়ে একটি প্রাচীন কাহিনি আপনাদের বলছি,আপনারা মন দিয়ে শুনুন। এই কাহিনি শুনলেই আপনারা সত্য উপলব্ধি করতে পারবেন।

সমান ঋষির ছেলে ছিলেন পাণিনি। খুব অল্প বয়সেই তিনি সকল শাস্ত্রে পন্ডিত হয়ে উঠলেন এবং যথেষ্ট সুনামও অর্জন করে ফেললেন। দেশে বিদেশে সব জায়গায় তার নাম ছড়িয়ে পড়ল। এক সময়কার ঘটনা, তখন বিদেশ থেকে একজন পণ্ডিত দিগবিজয় করতে বেরিয়েছেন, বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ঘুরে তিনি পাণিনির গ্রামে এসে লোকের মুখে মুখে পাণিনির কথা শুনলেন, এরপর তিনি পাণিনির বুদ্ধির শ্রেষ্ঠত্ব বিচার করার জন্য তাকে নিজে থেকেই তর্কযুদ্ধে আহ্বান করলেন। এরপর শুরু হল দুজনের মধ্যে তর্কযুদ্ধ। একে অপরকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে শুরু করলেন তারা। দুজনেই যুক্তি, বুদ্ধি, বিচার দিয়ে তর্ক করতে শুরু করলেন কিন্তু তর্কের একপর্যায়ে এসে পন্ডিতের কাছে তার হার স্বীকার করতে বাধ্য হলেন পাণিনি। দেশের পণ্ডিত যাকে এতদিন সর্বশ্রেষ্ঠ বলে জানত সে হেরে গেল।

পাণিনি ঠিক করলেন তাকে জ্ঞানপ্রাপ্তি করতে হবে, তাকে সিদ্ধ হতে হবে আর তার জন্য তাকে কঠোর তপস্যা করতে হবে। পাণিনি সেদিন স্থির করলেন তিনি সিদ্ধি লাভ করবেন, তাই আর কোথাও না গিয়ে তিনি সেখানে থেকেই তপস্যা শুরু করে দিলেন। তিনি মহাকাল শিবের আরাধনা শুরু করেন। তার এই তপস্যা ছিল অত্যন্ত কঠিন, প্রথমদিকে তিনি গাছের শুকনো পাতা খেয়ে থাকতেন, কিন্তু যতদিন যেতে থাকল তত তার তপস্যার কাঠিন্য বেড়ে যেতে থাকল।

একসময় তিনি গাছের পাতা খাওয়া ছেড়ে দিয়ে শুধু জল খেয়ে কাটালেন। এরপর সম্পূর্ণ অনাহারে থেকে মহাদেবের কঠোর তপস্যায় মগ্ন হলেন। এইভাবে এক মাস কেটে গেল পাণিনির কঠোর সাধনায় রুদ্র দেবের আসন নড়ে উঠল। তিনি পাণিনির সাধনায় প্রসন্ন হলেন তাই তিনি ভক্তকে দর্শন না দিয়ে থাকতে পারলেন না। পাণিনির সম্মুখে মহাদেব আবির্ভূত হয়ে বললেন, তোমার তপস্যায় আমি প্রসন্ন। কীসের জন্য এমন কঠোর তপস্যা করছ তুমি? আমাকে জানাও, কী তোমার মনের বাসনা? আমি অবশ্যই তোমার মনের ইচ্ছা পূর্ণ করব। মহাদেবের মনোহর মূর্তি দেখে পাণিনি আনন্দে আত্মহারা হয়ে বললেন হে মহেশ্বর আপনি যদি আমার প্রতি প্রসন্ন হয়ে থাকেন, যদি আমার মনস্কামনা পূর্ণ করতে চান তাহলে আমাকে এই বর দিন আমি যেন পৃথিবীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ যে তীর্থ সেই তীর্থ লাভ করি।

পাণিনির প্রার্থনায় তখন মহাদেব বললেন পৃথিবীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ তীর্থ হল মানস তীর্থ। তুমি নিশ্চয়ই সেই তীর্থলাভ করবে আর সেই তীর্থের জলে অবগাহন করলেই তোমার শুদ্ধ জ্ঞান প্রাপ্তি হবে। আমি তোমাকে আশীর্বাদ করছি আমার আশীর্বাদে তুমি মানস তীর্থ লাভ করে, সর্বত্র প্রসিদ্ধ হবে জ্ঞানের জন্য।

এই কথা বলে দেবাদিদেব মহাদেব অন্তর্হিত হলেন, পাণিনিও নিজের ঘরে ফিরে গেলেন। পরবর্তীতে পাণিনি মানস তীর্থের জলে স্নান করে নির্মল জ্ঞান লাভ করলেন, জ্ঞানের আলোকে তার মন ভরে উঠল। তারপর একের পর এক জ্ঞানগর্ভ রচনা করতে শুরু করলেন তিনি। সূত্রপাত, গণপাট, লিঙ্গ সূত্র, ধাতু পাঠ ইত্যাদি সব গ্রন্থ লেখার মাধ্যমে তিনি আজও চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।

তথ্যসূত্রঃ ভবিষ্য পুরাণ

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...