ভাদ্র-সংক্রান্তি ও অরন্ধন উৎসবের উৎসকথা

বাংলা বছরে দু'দিন অরন্ধন উৎসব পালিত হয়। মাঘ মাসে সরস্বতী পুজোর পরদিন শীতলষষ্ঠীতে শিলনোড়া পুজোর দিন, আর ভাদ্র মাসের সংক্রান্তিতে মনসা পুজোর দিন। এ দু'দিন উনুন জ্বালানো হয় না। তখন তার পূর্ণ দিবস বিশ্রাম। এ দু'দিন আগের দিনের রান্না করা খাবার অর্থাৎ বাসি বা পান্তা খাবার খাওয়া হয়। আমাদের আজকের আলোচনা ভাদ্র মাসের সংক্রান্তির অরন্ধন নিয়ে। এদিন কেন অরন্ধন পালন হয়? আসলে, এর সঙ্গে সংক্রান্তির মনসা পুজোর যোগ আছে তো, তাই এর উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে মনসার লৌকিক ব্রতকথার মধ্যে। যদিও এসব মোটেই ইতিহাস নয়, ইতিহাসের সাজে নেহাতই গল্পকথা। কল্পনাশক্তিতে অসম্ভব কার্যকারণকে মিলিয়ে দেওয়ার শিল্পিত পন্থা। আসুন, তবু সেটাই খুঁজে দেখি:

বেনের বাড়িতে চার ভায়ের চার বউ। আর আছে তাদের শাশুড়ি। বড়-মেজ-সেজ তিন বউয়ে খুব ভাব, ছোটটি যেন চোখের বালি। আসলে, শাশুড়ি ছোট বউকে দেখতে পারে না বলে, বাকি তিন বউও ছোট বউকে পাত্তা দেয় না। 

সেদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছে। বাতাসে শীত শীত ভাব। তাই রান্নাঘরে উনুনে হাত সেঁকছিল তিন জা আর আয়েশ করে গল্প করছিল। বড় জা বলল, ইস, আজ যদি খিচুড়ি আর বেগুন ভাজা হতো না, তাহলে খেয়ে খুব সুখ হত। মেজ জা আর সেজ জা বলল, এসময় যদি গরম গরম কলাই ভাজা পাওয়া যেত, তাহলে খুব ভালো হত। ছোট বউ রান্নাঘরেই তখন চুপ করে দাসীর মতো খাটছিল। কিন্তু, তিন জায়ের খাওয়ার গপ্পো শুনে আর থাকতে না-পেরে সেও বলে বসল যে, আজ যদি গরম ভাত আর পুঁটিমাছের টক পাওয়া যেত তাহলে বেশ খাওয়া হত। তিন জা তার কথা শুনে ঠোঁট বাঁকাল, গরীবের মেয়ে তার আবার মাছভাতের সাধ, মরে যাই! 

ওদিকে কিন্তু ছোট বউ স্নান করতে গিয়ে পুকুরের ঘাটের কাছে কিলবিল করতে দেখল দুটো মাছের ছানা, তাদের তুলে নিয়ে এসে রাখল ঘরের ভেতর হাঁড়িতে। তাই দেখে তিন বউ হিংসেয় মরে ভাবল, ইস আমাদের ইচ্ছেপূরণ হল না, আর ছোট বউ কিনা মাছভাত খাবে!

তিন বউ কী করল কে জানে, ছোট বউ চান টান করে এসে মাছ কুটতে এসে অবাক। ওমা, মাছ কোথায়, এ যে সাপের ছানা! সে যাই হোক, তার মায়ার শরীর, মনে ভালোবাসা। তাই সাপের ছানাদের তাড়িয়ে না-দিয়ে তাদের দুধ কলা খেতে দিল। তাদের সঙ্গে ভাই পাতিয়ে বড় করতে লাগল। এমনি করে দিন কাটতে লাগল। 

তারপর একদিন সাপের ছানারা বড় হয়ে স্বর্গে মা মনসার কাছে চলে গেল। সেখানে গিয়ে তারা মাকে বলল যে, মর্ত্যে যে-দিদি তাদের মানুষ করেছে, সেই দিদির বড় দুঃখ, বড় অভাব। শাশুড়ি উঠতে বসতে তাকে খোঁটা দেয়, জায়েরা তার ওপর গায়ের ঝাল মেটায়। তাই তাদের ইচ্ছে, দিদিকে এখানে এনে কিছুদিন আদরযত্নে রাখে। মা মনসা তাদের কথায় খুব খুশি হলেন। তখন নাগভাইরা ছোট বউকে স্বর্গে নিয়ে এলো। মা মনসাকে চোখের সামনে দেখতে পেয়ে ছোট বউয়ের আহ্লাদের আর সীমা রইল না। গলায় কাপড় দিয়ে সে মা মনসাকে গড় করল। মা বললেন, বাছা, তুমি এসেছ, এতে আমি খুশি হয়েছি, যদ্দিন ইচ্ছে হয় এখানে থাকো। কিন্তু সাবধান, কখনও দক্ষিণ দিকে চেয়ে ফেলোনা যেন, এতে তোমার অকল্যাণ হবে! ছোট বউ ঘাড় নেড়ে জানাল, আচ্ছা।

দিন যায়। একদিন নাগভাইদের জন্য দুধ গরম করতে গিয়ে কীভাবে যেন তার চোখ চলে গেল দক্ষিণ দিকে, সে দেখল মা মনসা নিরাভরণ নিরাবরণ হয়ে নৃত্য করছেন। সেই অপরূপ নাচ দেখে সে আর চোখ ফেরাতে পারল না। কতক্ষণ যে এভাবেই কেটে গেল, তার ইয়ত্তা রইল না। তখন সে দুধ গরম করতেই ভুলে গেল। এদিকে নাগেরা এসে যখন তার কাছে দুধ চাইল, তখন তার চমক ভাঙল। অমনি তাড়াহুড়োয় দুধ গরম করতে গেল, আর তাতে দুধ এমন গরম হয়ে গেল যে, খেতে গিয়ে নাগেদের জিভ পুড়ে গেল। আর এতেই নাগেরা তার ওপর ভীষণ ক্ষেপে গেল! তারা রাগে কাঁপতে কাঁপতে পরামর্শ করল, ছোট বউকে কামড়ে মেরেই ফেলবে! স্বর্গে কামড়ালে তার কিচ্ছু হবে না, তাই মর্ত্যে নিয়ে যেতে হবে তাকে। তারা মা মনসার কাছে গিয়ে তাদের রাগের কথা বলল। আর এও বলল যে, যেভাবেই হোক মা যেন ছোট বউকে মর্ত্যে তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দেন।

ছোট বউয়ের তো এবার ভারি বিপদ। ভাগ্যিস মা মনসার মায়া পড়ে গিয়েছিল তার ওপর। তিনি ঠিক করলেন, ছোট বউকে বাঁচাতে হবেই, আবার নাগেদেরও চটানো যাবে না। তাই তাদের কথা মতো, গা ভর্তি গয়না পরিয়ে মনসা নিজে ছোট বউকে মর্ত্যে রাখতে এলেন। রাগান্বিত নাগেরা ছিল তক্কে তক্কে। তাই তারাও লুকিয়ে মর্ত্যে এলো ছোট বউকে দংশন করে হত্যা করবে বলে। কিন্তু, মা মনসার কৃপায় ছোট বউ এমন কোন ভুল করল না যে, নাগেরা তাকে দংশন করে! 

মা মনসারই পরামর্শে ছোট বউ কাঁচা দুধ ও পাকা কলার নৈবেদ্য দিয়ে দেবী মনসার পুজো করল। স্বর্গে নাগভাইদের অত্যন্ত গরম দুধ দিয়ে জিভ পোড়ানোর প্রায়শ্চিত্ত করতে নিজের জন্যও এ-দিন সে গরম খাবার রান্না করল না। পান্তা খেল। ছোট বউয়ের ভক্তি, প্রায়শ্চিত্ত ও কৃচ্ছ্রসাধনা দেখে নাগেদের মনে আর কোন রাগ রইল না। নাগদের থেকে ছোট বউয়ের আর কোন বিপদের আশঙ্কাও রইল না। অরন্ধনের প্রেরণা এখান থেকেই পাওয়া। ফলে, সাপের ভয় দূরে রাখতে ও মনসার অনুগ্রহ পেতে ছোট বউয়ের প্রতি দেবীর এই কৃপার কথা স্মরণ করে ভাদ্র মাসের সংক্রান্তিতে দেবীর পূজা ও অরন্ধন আজও অনেক বাড়িতেই পালন করা হয়। 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...