প্রতি বছর রথযাত্রার আগে বাংলা থেকে পুরীর উদ্দেশে রওনা দেয় চৈতন্যদেবের প্রিয় খাবার

রথযাত্রার প্রাক্কালে আজও প্রতি বছর বাংলা থেকে পুরীর উদ্দেশে রওনা দেয় চৈতন্য মহাপ্রভুর প্রিয় খাবার। যার পোশাকি নাম রাঘবের ঝালি। রথযাত্রার আগে চৈতন্য মহাপ্রভু নীলাচলে থাকতেন। ভক্তরা তাঁর দর্শন পেতে বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শ্রীক্ষেত্রে ছুটতেন। ভক্তদের সঙ্গে থাকত চৈতন্যদেবের পছন্দের নানান খাবার। নদীয়ার নিমাই যে কী পরিমাণ ভোজন রসিক ছিলেন তার প্রমাণ চৈতন্যচরিতামৃতের ছত্রে ছত্রে মেলে। ভক্তদের কাঁধের ঝোলায়, মাথার ঝাঁকিতে ভর্তি ভর্তি করে থাকত মহাপ্রভুর পছন্দের খাদ্যসামগ্রী। কচু, থোড়, মোচার মতো মরশুমি সবজি থেকে নানা মরশুমি ফল, নাড়ু ও আচার, চাল, ডাল ও বিবিধ মশলা, তিতো শুক্তা, গঙ্গাজলী নাড়ু ও গঙ্গাজলী সন্দেশ। প্রায় পাঁচ শতকেরও বেশি সময় যাবৎ পুণ্যভূমি পানিহাটি থেকে রাঘবের ঝালি যাচ্ছে শ্রীক্ষেত্রে। এবারেও ব্যতিক্রম হয়নি। রওনা হয়ে গিয়েছে রাঘব পণ্ডিতের ঝালি। 

একদা গরুর গাড়ি বা নৌকায় করে ঝালি যেত। তারপর ট্রেনে চাপিয়ে মহাপ্রভুর পছন্দের খাদ্যসামগ্রী পুরীতে পৌঁছে দেওয়া হত। এখন অবশ্য বাসেই যায়। বৈষ্ণব ও চৈতন্য ভক্তদের কাছে রাঘবভবন পুণ্য তীর্থক্ষেত্রের চেয়ে কম নয়। 

চৈতন্যচরিতামৃতে রয়েছে; শচীর মন্দিরে, নিত্যানন্দ নর্তনে, শ্রীবাস অঙ্গনে আর রাঘব ভবনে, এই চারিঠাঁই প্রভুর সদা আবির্ভাব। ৯২১ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসের কৃষ্ণা দ্বাদশীতে চৈতন্য মহাপ্রভু পানিহাটিতে প্রথমবারের জন্য আসেন।

প্রিয় পার্ষদ রাঘব পণ্ডিতের বাড়িতে ওঠেন তিনি। রাঘব পণ্ডিতের বাল্যবিধবা বোন দময়ন্তীদেবী নানান পদ রান্না করে মহাপ্রভুকে খাওয়ান। চৈতন্যদেব মুগ্ধ হয়ে যান দময়ন্তীর রান্না খেয়ে। 

 

মহাপ্রভু যখন পুরীতে থাকতেন তখন বাংলা থেকে তাঁর শিষ্য ও ভক্তরা দেখা করতে যেতেন। জগন্নাথদেবের রথযাত্রার আগে তাঁরা হেঁটে পৌঁছতেন পুরী, সঙ্গে নিয়ে যেতেন দময়ন্তীদেবীর রান্না করা নানা খাবার। সেই রাঘবের ঝালিতে থাকত চাল, ডাল, নানাবিধ মশলা, কর্পূর, মরিচ, এলাচ, লবঙ্গ, শালি ধানের খইয়ের নাড়ু, ধানিয়া মুহুরী ধানের নাড়ু, বিভিন্ন ধানের খইয়ের মোয়া, চিঁড়ে, বাদাম, ক্ষীর, তিল ও শুটিখণ্ডের নাড়ু, আতপ চালের মুড়ির মোয়া, আদা কাসুন্দি, লেবু কাসুন্দি, ঝাল কাসুন্দি, আম কাসুন্দি, লেবু ও তেঁতুল, আমসত্ত, আমলকি, আমসি ইত্যাদি ছাড়াও থাকত কচু, থোড়, মোচা, কাঁঠাল, আম, আনারস, আম সহ নানা শাকসব্জি। তিলকের জন্য যেত গঙ্গাজল ও মাটি। দময়ন্তীদেবী ছিলেন রাঘবের বাল্যবিধবা ভগিনী। 

 

‘‘দময়ন্তীর দত্ত-দ্রব্যে সাজাইয়া।

নীলাচলে আইল রাঘব কাঁদিয়া কাঁদিয়া।।’’ 

 

আবার বলা হচ্ছে...

‘‘ঝালি মাথে নীলাচল পথে।

যায় রাঘব কেঁদে কেঁদে।।’’

 

ঝালির বিশেষ আকর্ষণ হিসাবে থাকত গঙ্গাজলি নাড়ু এবং সন্দেশ।

কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীর ‘চৈতন্যচরিতামৃতে’ও গঙ্গাজলি নাড়ুর উল্লেখ রয়েছে।

 

‘‘নারিকেল খণ্ড আর নাড়ু গঙ্গাজল।

চিরস্থায়ী খন্ড বিকার দিয়েছে সকল।।’’

 

পানিহাটিতেই সম্ভবত গঙ্গাজলি নাড়ুর জন্ম। শ্রীচৈতন্যদেবকে কেন্দ্র করে এই মিষ্টির জন্ম হয়েছিল পাঁচ শতক আগে, অধুনা সে মিষ্টি লুপ্ত। বাঘবের বাড়িতে নানান পদের সঙ্গে বানানো হয়েছিল বিশেষ প্রকার এই মিষ্টান্ন। যা পরবর্তীতে রাঘবের ঝালিতে জায়গা পায়। গঙ্গাজলি আদপে এক ধরনের নাড়ু। নারকেল খুব মিহি করে কুরিয়ে, চিপে দুধ বের করে নিতে হয়। দুধ চিপে নেওয়া নারকেল কোরা শুকনো খোলায় ভাজতে হয়, তবে লালচে হলে চলবে না। ভাজা হলে মিহি করে বেটে নিতে হবে। তার সঙ্গে গুঁড়ো করা চিনি মেশাতে হবে, কর্পূর দিতে হবে। এরপর গোল গোল ছাঁচ তোলা কাঠের পাটায় কাপড় বিছিয়ে এক একটা ছাঁচে চেপে চেপে নারকেল কোরা ভরতে হবে। শক্ত হলেই নাড়ু উঠে আসবে। নারকেল কোরার মিশ্রণ থেকে সন্দেশও তৈরি হত, তাকে ‘গঙ্গাজলি সন্দেশ’ বলা হত। 

 

কালের নিয়মে রাঘবের ঝালি পাঠানো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল প্রায়। ১১৩ বছর আগে রাধারমণ চরণ দাস দেব মহারাজ এই রীতি ফের চালু করেন। এখন গোটা বাংলা তথা নবদ্বীপ শান্তিপুর থেকেও ঝালির সামগ্রী যায় পুরীতে। রথযাত্রার আগেই নৈবেদ্য হিসাবে তা চৈতন্য মহাপ্রভুকে নিবেদন করা হয়।

 

এছাড়াও পুরীর জগন্নাথদেবের রথ যাত্রার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে চৈতন্যদেবের পদধূলি ধন্য কুলীন গ্রাম। চৈতন্যদেবের আদেশ মেনে পুরীর জগন্নাথের রথের জন্য এই কুলীন গ্রাম থেকেই পাঠানো হত রেশমের পট্টডোরী। তবে আজ সেই প্রথা লোপ পেয়েছে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...