ঋষি কাপুরের আংটি রাজেশ খান্না কেন ফেলে দিয়েছিলেন আরব সাগরের জলে!

তখন সত্তরের দশক। দেশ ফুটছে বদলের আবহাওয়া। রাজনীতি থেকে সিনেমা সবেতেই বইছে গরম হাওয়ার স্রোত। বয়ে চলা সেই গরম হাওয়ার মধ্যেই ঝড় তুলে বলিউডে প্রবল করলেন নীল চোখের টুকটুকে এক ছেলে। সিনেমার পর্দা থেকে ঝড় ছাপাল দর্শকদের মনেও। বিশেষ করে মহিলা হৃদয়ে। দেশের সিনেমা হলগুলোতে একটাই ক্রেজ- ববি।

b3dee504-2820-4171-a6a8-63c1a4915834

ডিম্পল আর ঋষি দুই নতুন নায়ক–নায়িকার প্রেমে পড়ল তামাম ভারত। ববি প্রিন্ট থেকে ববি জামা-জুতো-সানগ্লাস মায় হেয়ারকাটও।

১৯৭৩ সালে মুক্তি পায় রাজ কাপুর পরিচালিত টিনএজ রোম্যান্স ছবি ‘ববি’।  খাজা আহমেদ আব্বাসের গল্প।  এই ছবি দিয়েই পুত্র ঋষির ‘ডেবিউ’ ঘটালেন তিনি। একেবারে স্বপ্নের মতো।  দর্শকরা ঋষিকে আগেও দেখেছে। ‘মেরা নাম জোকার’ ছবিতে টিনএজার রাজ কাপুরের ভূমিকায়। পাতা চুল, গাবলুগুবলু চেহারা। মুখের সারল্য আর বিস্ময় ছাপিয়ে মনে থেকে যায় চোখ। অবিকল রাজ কাপুর। ঋষি নামের বদলে ‘চিন্টু’তে চেনা। তারও আগে শ্রী ৪২০-এ। প্যার হুয়া ইকরার হুয়া গানের দৃশ্যে তিন খুদের এক খুদে।

88ce341e-38df-4720-b9fa-f2c4aea20133

নীল চোখ গোলাপী ঠোঁট তেমনি আছে তবে এ যেন অন্য ঋষি। কোঁচকানো চুল, বেলবটম প্যান্ট, এনার্জিতে ভরপুর সদ্য তরুণ। ভারতীয় উপমহাদেশের নতুন হার্টথ্রব। ইন্ডাস্ট্রি দেখল স্টারডমের নতুন রূপকথা। ছবির পরিচালক-প্রযোজক বাবা রাজ কাপুর। আর এক ঝড় তোলা নবাগতা ডিম্পল কাপাডিয়ার সঙ্গে পর্দায় উত্তাল রোমান্স উত্তাপ ছড়ালো কত যে পাড়ায়-মহল্লায়, তার ঠিক নেই। ছবি শুধু ‘হিট’ নয়, বলা ভালো ‘হিস্টিরিয়া’।

বাবা রাজ কাপুরের স্বপ্নের কারখানা ‘আর কে ফিল্মস’র তখন আর্থিক দেনায় বন্ধক পড়েছে। ‘মেরা নাম জোকার’, ‘কাল, আজ আউর কাল’ দুই চ্ছবি পরপর ফ্লপ। আর্থিক সংকট বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে ঘুরে দাঁড়াতে চাই বিগ হিট। তাই মাথায় আসে ‘ববি’র পরিকল্পনা। রাজেশ খান্না তখন মধ্য গগমে। যে ছবি ছুঁয়ে দেন তাই সোনা। কিন্তু আকাশ ছোঁয়া পারিশ্রমিক। জোড়া ফ্লপের ধাক্কায় এত টাকা খুইয়েছেন যে  রাজেশ খান্নাকে নিজের ছবিতে নেওয়ার পরিস্থিতিতে তিনি নেই। তাই বাজি ধরলেন নিজের কুড়ি বছরের ছেলের ওপর। পুত্র ‘চিন্টু’ তখন বয়ঃসন্ধি পার করে সদ্য যৌবনে। এতগুলো বছর ধরে অভিনেতা-অভিনেত্রী তৈরী করে হীরে আর কাচ বোঝার ক্ষমতা প্রশ্নাতীত। স্নেহপ্রবণ পিতার চোখ দিয়ে নয়, হিটের খিদে বুকে নিয়ে ঘোরা এক পরিচালকের চোখ দিয়ে দেখেছিলেন ‘ঋষি কাপুর’কে।

ভুল করেননি তিনি। এভাবেই বলিউড পেল নতুন জুটি ঋষি আর ডিম্পলকে। লোকে এই জুটিকে এক ধাক্কায় তুলনা করেছিল ‘রাজ কাপুর আর নার্গিস’ জুটির সঙ্গে। সুপার ডুপার হিট হয়েছিল ছবি। আর কে স্টুডিয়ো ফিরে পেয়েছিল আহারানো গৌরব। বছরের সেরা বক্স অফিস সফল ছবির তকমাও পেয়েছিল ছবি। সোভিয়েত ইউনিয়নেও জনপ্রিইয়তা পেয়েছিল। 

জীবনের শেষবেলায় সংবাদমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ঋষি জানিয়েছিলেন, ‘ববির আর্থিক সাফল্যে অক্সিজেন পেয়েছিল আরকে ফিল্মসকে। বেরিয়ে আসতে পেরেছিল বন্ধকী জট থেকে। আসলে বাবা রাজকাপুর সারাজীবন যে অর্থই আয় করেছেন সবটাই বিনিয়োগ করতেন সিনেমায়। এভাবেই সিনেমার টাকায় তৈরী হত সিনেমা। অন্য কোনও ইন্ড্রাস্ট্রি থেকে আর্থিক বিনিয়োগ হয়নি কখনও।এতটাই প্যাশনেট ছিলেন সিনেমা নিয়ে’।

সেই সময় সাফল্যের সহজতম পথ হিসেবে রাজেশ খান্নাকে ছবিতে নেওয়া। নায়িকা হিসেবে শর্মিলা ঠাকুর বা মমতাজ। তাঁরাও রাজের সঙ্গে কাজ করার জন্য মুখিয়ে ছিলেন। কিন্তু রাজ ‘স্টার’ তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন না। তাঁর ভাবনা ছিল অন্যরকম। সেই জন্যই শেষ পর্যন্ত এই ছবিতে এসেছিলেন ঘরের ছেলে ঋষি আর আনকোরা নায়িকা ডিম্পল।

নিজের আত্মজীবনী ‘খুল্লাম খুল্লা’ প্রকাশের সময় ঋষি বলেছিলেন ববি তাঁর ‘মাস্টার পিস’। ডিম্পল কাপাডিয়ার সঙ্গে তাঁর জুটি এতটাই আসল মনে হয়েছিল যে তাঁর প্রেম ভেঙে গিয়েছিল।

IMG-20230904-WA0009

ঋষি তখন ইয়াসমিন মেহেতা নামে একটি পার্সি মেয়ের সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করছেন। বেশ সিরিয়াস সম্পর্ক। এদিকে ববি রিলিজ হতেই চিন্টু আর ডিম্পলের লাভস্টোরি নিয়ে মুখরোচক গল্প ছাপা হতে লাগল ফিল্মি ম্যাগাজিন আর ট্যাবলয়েডে। সেই সময়ের সবচেয়ে বিখ্যাত সিনেমা পত্রিকা ‘স্টারডাস্ট’ স্পেশ্যাল স্টোরি ছাপল তাঁদের প্রেমের কাহিনি নিয়ে।

ডিম্পল তখন বিবাহিতা। রাজেশ খান্নার স্ত্রী। ‘ববি’ মুক্তির বছরেই তাঁরা বিয়ে করেন। এই ছবিতে সেরা অভিনেত্রীর সম্মান পেলেও বলিউডকে বিদায় জানিয়েছিলেন তিনি। সিনেমা ম্যাগাজিনের সেই স্টোরিতে তাঁদের সম্পর্কে তেমন কোনও প্রভাব ফেলতে পারল না। রাজেশ পরিণত। জানতেন কেমন হয় ট্যাবলয়েডের গসিপ। কিন্তু সম্পর্ক ভেঙে গেল ঋষি আর ইয়াসমিনের। অনেক চেষ্টা করেছিলেন ঋষি কিন্তু নারাজ ইয়াসমিন আর ফিরতে চাননি ।

ইয়াসমিন আংটি দিয়েছিলেন ঋষিকে। সেই আংটি সব সময় থাকত তাঁর আঙুলে। সেই আংটি নিয়েও বড় কান্ড ঘটেছিল বলে শোনা যায়। ‘ববি’র শুটিং চলার সময় ঋষির আঙ্গুল থেকে আংটি খুলে ডিম্পল সেটা নিজের আঙুলে পরেছিলেন। তাঁর খোলেননি। রাজেশ যখন ডিম্পলকে সম্পর্কের জন্য প্রস্তাব দিলেন তখন নাকি ডিম্পলের আঙুলের সেই আংটি খুলে ফেলে দেন জুহুর সমুদ্রে। পরে বিনোদনের পাতায় হেডলাইন বের হয় ‘ঋষি কাপুরের আংটি রাজেশ খান্না ফেলে দিলেন সাগরের জলে’। কিন্তু আসল সত্যিটা তাহলে কী? সেই প্রশ্নের উত্তর লিখলেন ঋষি নিজের আত্মজীবনীর পাতায়, ‘সত্যি হল আমি কখনই ডিম্পলের প্রেমে পড়িনি। এমনকি ইনফ্যাকচুয়েশনেও না’।

২০২৩-এ পঞ্চাশ বছর হল ‘ববি’র। ডিম্পল আছেন। ঋষি নেই। আর আছে ঋষির আত্মজীবনীর খোলা পাতা। শুরু থেকে একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এখন বইয়ের র‍্যাকে শান্ত হয়ে শুয়ে। অনেকটা ঋষির মতোই। অজস্র ভাঙচুর, দস্যিপনার এক দুরন্ত জীবন কাটিয়ে দেশজোড়া লক ডাউন আর করোনার বিপন্নতার মাঝে হঠাৎ শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়া রাজ-পুত্র।  

 

তথ্যসূত্রঃ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস   

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...