চায়ের চক্করে বিবেকানন্দ

চা-চক্র। হ্যাঁ, চায়ের চক্করে নবস্থাপিত বরানগর মঠে (১৮৮৬) তখন অনেকেই আসতেন সকালে এবং বিকেলে। 'অনেকেই' মানে শ্রীরামকৃষ্ণসান্নিধ্যে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরা--সুরেশচন্দ্র মিত্র, মাস্টারমশাই মহেন্দ্রবাবু প্রমুখ। মঠের তখন ভিক্ষামুষ্ঠি সম্বল। দুধ-চিনির সামর্থ্য নেই। তাই খাওয়া হত শুধু লাল চা। বিবেকানন্দভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ দত্তের স্মৃতি মতে : "গুঁড়ো চা গরম জলে দিয়ে একটু কড়া করে নেয়, আর তাই ঢক ঢক করে খায়, দুধ চিনির ত নামই নাই।" তাই বলে মাঝে মাঝে যে চায়ের ভোল বদল হত না, এমনটাও নয়--যেদিন যেদিন সুরেশবাবু বা মাস্টারমশাই দুধ ও চিনির জোগানদারের ভূমিকা নিতেন, সেদিন সেদিন লালিমা ঘুচিয়ে দুধসহ মিষ্টি চা খাওয়ার সৌভাগ্য হত বিবেকানন্দসহ গুরুভাইদের। মঠে চা-টা শুরু থেকেই বেশ গুরুত্ব পেয়ে গেল। নেশার তলব থেকে নয়, অর্ধাহারী মঠবাসীদের খিদে মারার মহৌষধ হিসেবে। আর অনুপানের স্বীকৃতি পেয়ে বেশ পশার জমিয়ে ফেলল হুঁকোকল্কের তামাকু। পান ও অনুপানের অবসরে ধীরে ধীরে জমে উঠল আড্ডা। গুরুচিন্তা থেকে শুরু করে মঠের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার সরণি বেয়ে আড্ডা শেষ হত গিয়ে শাস্ত্রের দুরূহ কোন মীমাংসায়। চা-পান উপলক্ষে শুরু হলেও আড্ডা শেষে দেখা যেত, চা কখন শেষ এবং পাত্র শুকিয়ে কাঠ। এভাবে কখনো বেলা গড়িয়ে দুপুর, কখনো বা সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত ঘনিয়ে কোথা দিয়ে যে সময় চলে যেত কেউ টেরই পেতেন না।

১৮৯৭ সালে যখন মঠের নিয়ম ও মাদক-নেশার বিরুদ্ধে বিধিনিষেধ লিপিবদ্ধ হচ্ছে, তখন তামাককে একেবারে নাম করে ব্যতিক্রমের মধ্যে ফেলে বৈধতা দিয়ে দিলেন বিবেকানন্দ। নেশার বস্তু হিসেবে চা-কে ধর্তব্যের মধ্যেই আনলেন না। কারণ, ততদিনে চা হয়ে উঠেছে মঠের নিত্য-পানীয়। পরিব্রাজনকালে যেচে কারও ঘরে তিনি ভোজন করতেন না, কারও ঘরে চট করে আতিথ্য নিতেও রাজি হতেন না। তবে, তেমন কোন ভক্ত বা সজ্জন সুখাদ্য, তামাক এবং চা-পানের নেমন্তন্ন করলে তিনি রাজি হতেও দেরি করতেন না। সমগ্র সন্ন্যাসীজীবন অনেক অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে কাটালেও, তাঁর প্রথম বিদেশ যাত্রার সময়টি কিন্তু বেশ  সুখস্মৃতির ছিল। ১৮৯৩ সালে তিনি এস এস পেনিনসুলা জাহাজের যাত্রী। চলেছেন জাপানের পথে। এ-যাত্রায় তিনি প্রথম শ্রেণির যাত্রী, তাই অর্ডার মাত্রই চা ও কফি সঙ্গে সঙ্গে হাজির হত। তিনি যেখানেই থাকুন না কেন, জমিয়ে ফেলতে ওস্তাদ। ফলে, দু'একদিনে জাহাজের বিদেশি যাত্রীদের সঙ্গে ধর্মচর্চায়-তত্ত্ব আলোচনায় পুরোদমে জমিয়ে ফেললেন। সেই সঙ্গে অবসর মতো চা-কফি ও চুরুটের পর্যাপ্ত যোগান তাঁর যাত্রাপথটিকে যাকে বলে 'স্বর্গীয়' করে তুলল।

মহালয়ার বেশ কিছুদিন আগের কথা। বিবেকানন্দ ও গুরুভাইদের হাতে লিকার চা। মঠে জমে উঠেছে আড্ডা। কথা হতে হতে হাতের চা তুলে শিবানন্দ হঠাৎ প্রস্তাব দিলেন--'সব রকমের তর্পণই তো হল, এবার কিন্তু চা দিয়ে তর্পণ করতে হবে'। বিবেকানন্দের ঠোঁটে প্রশ্রয়ের হাসি ফুটল। ব্যস, সবাই বেশ উৎসাহ পেয়ে গেলেন। রচিত হয়ে গেল চা-চর্চিত সংস্কৃত--'অনয়া চায়য়া...' ইত্যাদি মন্ত্র। আসলে, এই অভিনব প্রস্তাবনার মূলে একটি অনুষঙ্গ আছে। শিবানন্দ আগের বছর বুদ্ধগয়ায় গিয়ে ভুটিয়াদের দেখেছেন চা নিবেদন করে পুজোআচ্চা করতে, আর সেটাই বক্ষ্যমাণ চায়ের আড্ডায় তাঁর মনে পড়ল--এবং তিনি প্রসঙ্গটি তুলে ফেললেন। এই হচ্ছে ইতিহাস। তবে, অভিনব এই প্রস্তাবনা বিবেকানন্দের মনে ধরলেও তা বাস্তবায়িত হয়েছিল কি না জানা যায় না।

তথ্য ঋণ : শ্রীমৎ বিবেকানন্দ স্বামীজীর জীবনের ঘটনাবলী- মহেন্দ্র নাথ দত্ত।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...