রায় কৃষ্ণদাস পাল বাহাদুর, সি আই ই: ভুলে যাওয়া একজন বিখ্যাত সাংবাদিক

কলেজ স্ট্রিট ধরে বিধান সরণির দিকে এগোলে, পড়বে মহাত্মা গান্ধী রোডের সংযোগস্থল। এখানে একটা পুরনো এবং বড়ো শাড়ির দোকান আছে, নাম ‘আদি মোহিনীমোহন কাঞ্জিলাল অ্যান্ড সন্স’। ঠিক সেই দোকানটির বিপরীতে রাস্তার পাশে ফুটপাথের ওপরে রয়েছে এক ভদ্রলোকের পাথরের ফুল সাইজ মূর্তি, যাকে আশেপাশের দোকানিরা পলিথিন শিটে প্রায় ঢেকেই ফেলেছে! 

এই ভদ্রলোকের নাম রায় কৃষ্ণদাস পাল বাহাদুর, সি আই ই। পরিশ্রম, সততা ও অধ্যবসায় থাকলে মানুষ জীবনে কত উন্নতি লাভ করতে পারে, দেশবাসীর কাছে তিনি তার জীবন্ত দৃষ্টান্ত।

রায় কৃষ্ণদাস পাল বাহাদুর ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় জোড়াসাঁকো অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে। নিজের বাড়িতে কিছুদিন রেভারেন্ড মিঃ মর্গ্যানের কাছে শিক্ষালাভের পর, তিনি ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু মেট্রোপলিটন কলেজে ভর্তি হন। কলেজে তিনি ক্যাপটেন ডি এল রিচার্ডসন, ক্যাপটেন এফ পামার, ক্যাপটেন হ্যারিস, মিঃ উইলিয়ম কার্ক-প্যাট্রিক এবং মিঃ উইলিয়াম মাস্টার্সের মতো শিক্ষকদের স্নেহভাজন হয়ে ওঠেন।

kolkata story

১৮৫৭ তে তিনি কলেজ-জীবন শেষ করলেও, নিয়মিত পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকেন। ‘মর্নিং ক্রনিকল্’, ‘হিন্দু ইন্টেলিজেন্সার', 'দি সিটিজেন', 'দি ফিনিকস', 'দি হরকরা', 'দি হিন্দু প্যাট্রিয়ট' প্রভৃতি পত্রিকায় নিয়মিতভাবে এবং কখনও কখনও 'দি ইংলিশম্যান' পত্রিকাতেও লিখতেন তিনি। কানপুর থেকে প্রকাশিত 'দি সেন্ট্রাল স্টার' নামক পত্রিকাটির তিনি কলকাতার সংবাদদাতা ছিলেন।

কলকাতার বিখ্যাত 'দি হিন্দু প্যাট্রিয়ট' পত্রিকার সম্পাদক বাবু হরিশচন্দ্র মুখার্জীর মৃত্যুর পর, তিনি সেই পত্রিকার সম্পাদক হন (১৮৬০ থেকে ১৮৬১ পর্যন্ত)। এছাড়াও তিনি কলকাতা পুরসভার কমিশনার, কলকাতা পুলিশের অনারারী ম্যাজিস্ট্রেট, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সচিব এবং বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সভ্য ছিলেন। ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে ১ জানুয়ারি দিল্লী দরবারে তাঁকে ‘রায় বাহাদুর’ খেতাবে ভূষিত করা হয় এবং ১৮৭৭-র ১৪ আগস্ট বাংলার ছোটলাট বাহাদুর বেলভেডিয়ারে তাঁকে নিম্নোদ্ধৃত সনদ দান করেন:

'বাবু,

'দেশীয় জনগণের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট সর্ববিষয়ে বহু বছর যাবৎ আপনি মুখ্য ভূমিকা নিয়েছেন। আপনি উপযুক্তভাবে এবং আগ্রহ সহকারে আপনার স্বদেশীবাসীর স্বার্থ ও অধিকার সম্পর্কে লেখনী চালনা করেছেন এবং আপনি ইঙ্গ-বঙ্গ সংবাদপত্রকে উচ্চ ও প্রভাবশালী স্থান দিয়েছেন। সমভাবেই আপনি বঙ্গীয় আইন পরিষদের সভ্য, পৌর কমিশনার এবং বহু বোর্ড ও কমিটির সভ্যরূপে (দেশের) সেবা করেছেন; কোনরূপ বিরক্তি প্রকাশ না করে আপনি বহু মূল্যবান সহায়তা করায় সরকার আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ এবং তারই স্বীকৃতিস্বরূপ আপনাকে 'রায় বাহাদুর' পদবী দান করা হচ্ছে।'

১লা জানুয়ারি ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি 'কম্‌প্যানিয়ন অব দি অর্ডার অব দি ইন্ডিয়ান এম্পায়ার' পদবীতে ভূষিত হন। তাঁর সরল জীবনযাত্রা, শিক্ষা ও জ্ঞানের বিশালতা এবং চরিত্রগুণের জন্য তিনি এদেশে এবং বিদেশে বহু ইউরোপীয় ও দেশীয় ব্যক্তির শ্রদ্ধা অর্জন করেন। দেশবাসীর মঙ্গলের জন্য তিনি জনগণের সকলপ্রকার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। বাবু হরিশচন্দ্ৰ মুখার্জীর মৃত্যুর পর ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকাটি ডুবে যেতে বসেছিল; কৃষ্ণদাস পাল নিজের পরিশ্রম, উৎসাহ ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে পত্রিকাটির হাল ধরেন। এর ফলে, তিনি সর্বশ্রেণীর জনগণের সবিশেষ আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন।

ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি। প্রচন্ড পরিশ্রম এবং অনিয়মিত জীবনযাত্রার জন্য তিনি ডায়াবিটিস (মধুমেহ) রোগে আক্রান্ত হন, এবং ১৮৮৪ সালের ২৪শে জুলাই তিনি দেহত্যাগ করেন। 

এরপরে ১৮৮৫-এর ১০ জানুয়ারী কৃষ্ণদাস পালের স্মৃতিরক্ষার্থে কিছু করার জন্য, লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যর অগাস্টাস রিভার্স থম্পসনের সভাপতিত্বে একটি জমায়েতে কমিটি গঠন করা হয়। এখানে ডাক্তার মহেন্দ্র লাল সরকারের প্রস্তাব দেন, একটি মর্মরমূর্তি প্রতিষ্ঠার, এবং সেটি সমবেতভাবে গৃহীত হয়। সংগৃহীত হয় ১৪০০০ টাকা, এবং স্কটল্যান্ডের ভাস্কর থমাস নেলসন ম্যাকলিওন তৈরি করেন সেই অভিজাত ভঙ্গিমায় দণ্ডায়মান মার্বেল স্ট্যাচু, গ্রানাইট পাথরের একটি ভিত্তির ওপরে। ১৮৯৪ সালের ৬ই মার্চ হ্যারিসন রোড ও কলেজ স্ট্রিটের সংযোগস্থলে বসে এই মূর্তি, আবরণ উন্মোচন করেন গভর্নর জেনারেল লর্ড এলগিন। এই বাগ্মী, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ ভদ্রলোকের মৃত্যুতে লর্ড রিপন বলেছিলেন,

"By this melancholy event we have lost from among us a colleague of distinguished ability, from whom we had on all occasions received assistance, of which I readily acknowledge the value. . . . Mr. Kristo Das Pal owed the honourable position to which he had attained to his own exertions. His intellectual attainments were of a high order, his rhetorical gifts were acknowledged by all who heard him, and were enhanced when addressing this council by his thorough mastery over the English language."

আজকে রাস্তার মোড়ে দোকানের ছাউনির ভিড়ে আর গাড়ির হর্নের আওয়াজে, এই মূর্তিটার দিকে আর চোখ পড়ে না। স্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে বৃটিশ আমলের কলকাতায় কোনও সাংবাদিকের প্রথম মর্মর মূর্তি।

তথ্য সূত্র:

১. কলকাতার বাবু বৃত্তান্ত (১৬৮০–১৮৮০) - লোকনাথ ঘোষ

২. wikipedia.org/wiki/Kristo_Das_Pal

---

সলিল হোড় 

ঐতিহ্য গবেষক

কুঁদঘাট (দক্ষিণ কলকাতা)

৯৯০৩৬ ৯৯৯১৯

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...