‘বাবা শিশুর মতো বায়না করছে বাড়ি যাওয়ার’

চিন্ময় মুখোপাধ্যায়, হাওড়া

 

একটা মাঝারি মাপের অশ্বত্থ গাছের নিচে বসে আছি, হালকা জলপাই রঙের পাতার ওপর এসে পড়ছে শীতের সকালের রোদ্দুর। আশেপাশে অনেক মানুষের ভিড়,গাছের নিচটা সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো, অনেকে বসতে পারে, ছায়া পায় রৌদ্রের তাপ থেকে, জীবনের খররৌদ্র থেকে....জেলা হাসপাতালের বাইরেটায় কতো দূর দূর থেকে মানুষ এসেছেন আরোগ্য পেতে, তাদের সঙ্গের ব্যাগপত্তর  দিচ্ছে দূরত্বের আভাস, ইতস্তত ডাক্তার নার্স চিকিৎসা কর্মীদের যাতায়াত, মাঝেমধ্যে এক একটা অ্যাম্বুলেন্স আসছে যাচ্ছে। কতো অনিশ্চয় ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানকার হাওয়ায়। কে আরোগ্য নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারবে ম্লান হাসিমুখে আর কে এখান থেকেই চিরআরোগ্য নিয়ে পাড়ি দেবে মহাপ্রস্থানের পথে,উড়োখই এখানে ওখানে ভেসে বেড়াবে পায়ের ছাপ ধরে, ধূপের গন্ধ মিলিয়ে যাবে নশ্বর জীবনের মধ্যে.....এইসব সাপলুডো খেলা চলে রাত্রিদিন। জীবনের সঙ্গে মৃত্যুর ক্লান্তিহীন দ্বৈরথ। এরকমই একটা শীতের ক্লান্ত সকালে বসে ভাবছি বাবার কথা, সামনের বিল্ডিংয়ের তিনতলায় মেল ওয়ার্ডে বাবা ভর্তি আছে,বিছানায় শুয়ে শুয়ে বাবাও হয়তো কারও কথা ভাবছে, হয়তো মৃত্যুর কথাই!

শেষ জীবনে মানুষের শৈশব সত্যিই ফিরে আসে, মাঝখানের সময়টা মুছে যায়, তাই মাঝেমধ্যে বাবা আমাদের চিনতে না পারলেও দিব্যি গল্প করে যাচ্ছে ছেলেবেলার, বন্ধু বান্ধব, আত্মীয়স্বজনের কথা, পুরোনো পাড়ার কথা। শহরের একটা হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে অলিগলি পাশ কাটিয়ে বাবা দিব্যি পৌঁছে যাচ্ছে অনেক দশক আগের এক মফঃস্বল শহরে, দূরে দূরে এক একটা বাড়ি, অনেক সবুজ মাঠ আর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া গঙ্গার তীরে, হাফপ্যান্ট পরা বন্ধু বান্ধবদের ভিড়ে, পুরোনো স্যাঙাতদের খেলায়,তাদের অনেকেই হয়তো আজ স্মৃতি হয়ে গেছে, তবুও তারা কিরকম উজ্জ্বল হয়ে উঠছে থেকে থেকে এই মেল ওয়ার্ডের আধো আলো আধো অন্ধকারে, ওষুধ-বিষুধের গন্ধে,সাদা পোশাক পরা নার্সদের ব্যস্ত যাতায়াতে।

বাবা মাঝেমধ্যেই শিশুর মতো বায়না করছে বাড়ি যাওয়ার জন্য, রীতিমত জেদ, কিন্তু যে বাড়িতে ফিরতে চাইছে,সে বাড়ি আমি চিনিনা, সেই কোন শৈশবের বাসাবাড়িতে ফিরতে তাঁর মন কেমন করছে, এই নগরের অলিগলি পাকস্থলীর মধ্যে দিয়ে কোন যাদুমন্ত্রে যে সেই শৈশবের বাড়িতে যাওয়া যায়,আমি জানি না।

"যে পথ সকল দেশ পারায়ে       উদাস হয়ে যায় হারায়ে,সে পথ বেয়ে কাঙাল পরান যেতে চায় কোন্‌ অচিনপুরে..."  কোন অচিন পল্লীর বাসায় বাবা আরোগ্য নিয়ে ফিরতে চেয়েছিল এই বছরের সমুদ্র পেরিয়ে,আমরা সেই পথ খুঁজে পাইনি..... সপ্তাহখানেক পর বাবা নিজেই একদিন রাস্তা খুঁজে নিয়ে ভোর ভোর বেড়িয়ে পড়ল সেই বাড়ির দিকে, তখন সারারাতের বৃষ্টি থেমে মেঘের অন্ধকার কেটে গেছে, কিছু কিছু আলো ফুটছে অনির্বাণ আকাশে, বাবার জন্য শৈশব এক্সপ্রেস দাঁড়িয়ে আছে,ট্রেনের লম্বা হুইসেল পড়ছে,একটু পরেই আমাদের কাজে ব্যস্ত শহরটা ছেড়ে গঙ্গার পাড়,শ্মশানঘাটের পাশ ঘুরে কু-ঝিক-ঝিক করে পাড়ি দেবে সেই অনেক বছর আগেকার সাদাকালো ছবির মতো একটা মফস্বল স্টেশনে,যেখানে হাসিমুখে অপেক্ষা করে আছে বাবার ছেলেবেলা, পরিচিত বন্ধু বান্ধব। একটাও পাতা নেই, এমন একটা বনষ্পতির নিচে দাঁড়িয়ে মনে করার চেষ্টা করছি বাবার মতো আমার ছেলেবেলাটাকে, অফিস থেকে ফিরে পুরোনো সাইকেলে বসিয়ে গঙ্গার পাড়ে হাওয়া খেতে নিয়ে যাচ্ছে বাবা,আমি খুব খুশিমনে দেখছি চারপাশটা উজ্জ্বল শৈশব দিয়ে, হাওয়ায় চোখ বুজে আসছে আর হাওয়ায় হাওয়ায় ভাসছে -

"মধুবাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ ।

মাধ্বীর্ণঃ সন্তোষধীঃ মধু নক্ত মুতোষসো,

মধুমৎ পার্থিবং রজঃ মধু দ্যৌরস্তু নঃ পিতা ।।

মধুমান্ নো বনস্পতির্ মধুমাঁ অস্তু সূর্য্যঃ ।

মাধ্বীর্গাবো ভবন্তু নঃ ।।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...