‘ভয় কী বাবা? এই তো আমি আছি’

দেবতনু ভট্টাচার্য

বেহালা

 

'পানি পানি রে, খারে পানি রে

নয়নো মেঁ ভর যা

নিন্দে খালি কর যা...'

 

গানটা গাড়ির সাউন্ড সিস্টেমে শুনছিলাম বসে বসে। জল্পেশ শিব মন্দির থেকে আরও ছ'কিলোমিটার খানেক ভেতরে গেলে পড়ে জটিলেশ্বর শিব মন্দির। প্রাচীনত্ব এবং ঐতিহাসিক দিক থেকে জল্পেশের চেয়েও অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ এই মন্দির। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার বোর্ড লাগানো আছে এখানে।

ওখানেই গিয়েছিলাম আমি। ফিরতি পথে একটা গাছের ছায়ায় গাড়িটা দাঁড় করিয়ে মনোরম গোধূলি উপভোগ করছিলাম। ঠিক তখনই গানটি বেজে উঠেছিল।

২০২০-র শেষ থেকে প্রায় ষোল মাসের কিছু বেশি সময় ধরে আমাকে পড়ে থাকতে হয়েছিল উত্তরবঙ্গে। কর্মসূত্রে ঘুরতে হয়েছিল বাংলাদেশ লাগোয়া এমন প্রান্তিক কিছু গ্রাম, জিপিএস যেখানে ঠিকমতো কাজ করে না, নেই কোনও মোবাইল নেটওয়ার্ক। বাবা সে'সব জেনে যেতে পারেননি৷ ২০২০ সালের জুন মাসের ১১ পুহিয়ে সবে ১২য় পড়েছে। রাত বারোটা বেজে চল্লিশ মিনিটে আমি তখন আমার ঘর লাগোয়া পেছনের বারান্দায় রাতের শেষ সিগারেট খাচ্ছি। হঠাৎ শুনি বাবা 'ওফ্ ওফ্' করতে করতে হাঁফাতে হাঁফাতে এসে দরজার সামনে থেকে কোনোমতে 'অ্যাই' করে চিৎকার করে ডেকে উঠলেন। আমার ‘বুকুন’ নামটুকু উচ্চারণ করে ডাকার মতো অবস্থায় তিনি ছিলেন না সেই মুহূর্তে।

ছিটকে বেরিয়ে এসেছিলাম। আমি আর আমার স্ত্রী জয়ী। দোতলার উত্তরের ঘরে বাবা শুতেন। আমি আর জয়ী মাঝের ডাইনিং পেরিয়ে দক্ষিণের ঘরে। নীচের দক্ষিণের ঘরে শুতেন আমার মা। যেখানে তিনি এখনও থাকেন, যেখানে এখনও বাবা-মায়ের বিয়ের খাটটি রাখা আছে।

দু'দু'খানা সরবিট্রেট মুখে দিয়েও বুকের ধড়ফড়ানি কমানো গেল না। এদিকে লকডাউন তখনও পুরোপুরি না ওঠায় অতো রাতে অক্সিজেন বাড়ন্ত। অনেক কষ্টে বাবাকে দোতলা থেকে নীচে নামালাম। ধরে ধরে বাবাকে নামাচ্ছি নীচে, আর বাবাও আমাকে শেষ অবলম্বনের মতো আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইছেন৷ আমি শক্ত করে ধরে আছি দু'হাতে তাকে, আর বলছি, ভয় কী বাবা? এই তো আমি আছি!

মুখে কিছু না বলে কাচ নামিয়ে এসি ফুল স্পিডে চালিয়ে ঝড়ের বেগে গাড়ি চালালাম। যতোটা ঝড় তোলা সম্ভব ছিল খানা-খন্দ-স্পিড ব্রেকার আর ভাঙা মাঝের হাট ব্রিজ বাঁচিয়ে বিএম বিড়লা অবধি নিয়ে যেতে। তবু যেতে যেতেই বুঝেছিলাম বাবা আর নেই। বড়ো ভালোবাসার ছিল এই গাড়িটা তাঁর। মুম্বাইয়ে কিনেছিলাম তাঁকে কিচ্ছুটি না জানিয়ে। যেদিন কলকাতা থেকে উড়ে গিয়েছিলেন মা'কে নিয়ে,  সারপ্রাইজ দিতে এয়ারপোর্টে নিয়ে গিয়েছিলাম। চড়ে তাঁর সে কী খুশি! বারবার বলতেন বড্ড ভাল হয়েছে গাড়িটা, বড়, উঁচু, চওড়া। অমনি আমারও বুকের পাটা চওড়া হয়ে যেত সে'কথা শুনে।

সেই গাড়ি নিয়েই দাঁড়িয়েছিলাম জলপাইগুড়ি জেলার জল্পেশ আর জটিলেশ্বর মন্দিরের মাঝামাঝি। গানটা শুনতে শুনতে চোখ জলে ভরে উঠল অকস্মাৎ! অথচ লতা মঙ্গেশকরের এই গানটি কতবার কত জায়গায় যে শুনেছি! মনে হল যেন আমার ঠিক পিছনের সীটে বসে বাবাও গানটা শুনছেন। যেখানে তিনি শেষবারের মতো বসেছিলেন হাসপাতাল নিয়ে যাবার সময়৷

লোকে বলে বাপ-মা চলে গেলে বোঝা যায় বটগাছের ছায়া সরে গেল। লোকে বলে বাবা হলে বুঝবি কী জিনিস! সাপের বাচ্চাকেও মারতে কষ্ট হবে, মনে হবে আহা! ওরও তো বাবা আছে।

আমার কোনওটিই হয়নি। আমি বাবা হতে পারিনি যে। বিয়ের সুদীর্ঘ ন'বছর পর ২০১৮-য় যখন প্রথমবার জয়ী কনসিইভ করল, আমরা তখন সবেমাত্র মুম্বই পৌঁছেছি। থিতু হতে পারিনি। মাত্র দেড় মাসের মাথায় যখন জানা গেল ফেটাস ডেড, আমরা তখন অসহায়, ছাতাহীন। বাড়িতে জানালাম। জানালাম যদি কেউ আসতে পারে, এসে থাকতে পারে, বাবা হার্টের পেশেন্ট হওয়ায় নিদেনপক্ষে মা অন্তত। কিন্তু না, কেউই আসতে পারেননি। মা এসেছিলেন পরে, প্রায় মাসখানেক পরে। ডাক্তার বলেছিল জয়ীর ভেতরটা কাঁচা রয়ে গেছে ওয়াশের পর। ফলে দিন সাতেক রক্ত ঝরবে। দু'জনেই মানসিকভাবে বিধ্বস্ত তো ছিলামই। ওই অবস্থায় কখনও আমি অফিস যাবার আগে, কখনও জয়ী অসুস্থ অবস্থায় সকাল-বিকেল সেদ্ধ ভাত বানিয়ে খেয়ে চালিয়েছি। মুম্বাইয়ে থিতু হতে হতে সেই মুহূর্তে কোনও কাজের লোক কিংবা অন্য কিছু ঠিক করা সম্ভব ছিল না। টাকাও ছিল না একথা সত্যি। আর জয়ীর মায়ের পক্ষে আসা সম্ভব ছিল না। জয়ীর বাবা আমাদের বিয়ের আগেই চলে গিয়েছিলেন, আর মা ছিলেন নন-অ্যালকোহলিক লিভার সিরোসিসের পেশেন্ট, স্টেজ ফোর।

এই আঘাত আসলে আমাদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করেছিল। ফলে বটগাছের ছায়ার অভাব আর কোনোদিনই অনুভূত হয়নি। তবে এখন, এতদিন পরে এই বিষয়টার অন্য ডাইমেনশনগুলি দেখতে পাই। অচেনা শহরে ওই অবস্থার সময় অসুস্থ বুড়োবুড়ি গিয়ে আরও বিড়ম্বনা বাড়তে পারে, হয়ত এই ভাবনা ছিল তাঁদের মনে। আর শোক তো ছিলই৷ এতদিন পরে বিষয়টি নিয়ে লিখলেও, বাবার প্রতি এ বিষয়ে আর কোনও অভিযোগ নেই আমার।

বরং ২০২০ তে বাবা চলে যাবার পর, একটা বিরাট শূন্যতা গ্রাস করল আমায়। মনে হতো, এত যে গান, এত যে গায়ক-গায়িকা, কই, এই গানটা তো শোনানো হলো না বাবাকে? আলোচনা হলো না অমুকের গাওয়া গানটা নিয়ে। যেমন হয়েছিল ২০১৫ সালে আমার নতুন কেনা নীল রঙের সুইফট গাড়িতে তাজপুর যেতে যেতে। মা মামাবাড়ি যাওয়ায়, আমি, জয়ী আর বাবা দু'দিনের জন্য তাজপুর চলে গিয়েছিলাম। সারা রাস্তা বাবা রাগাশ্রয়ী গান গাইতে গাইতে গিয়েছিলেন। রসিক মানুষ প্রীতমের সুরে 'দিল মেরা মুফত কা' গানটি শুনে তারিফ করেছিলেন, জিজ্ঞেস করেছিলেন গানটা কে গেয়েছে তাই নিয়ে। মুখে বলেছিলাম জানি না, মনে ভাবছিলাম যে 'এজেন্ট ভিনোদ' মুভিটার এই গানটা যতবার আমি শুনি, করিনা কাপুরের পাশে মারিয়ম জ়াকারিয়ার কথাই আমার বেশি মনে পড়ে, তাই গায়িকার খোঁজ আর নেওয়া হয়ে ওঠে না।

বাবাকে নিয়ে লিখতে বসলে শেষ হবার নয়। ছোটোবেলায় রাসবিহারী চত্বরে থাকতাম। খাকি রঙা হাবিলদার হাফ প্যান্ট পরে বাবার সাথে মার্চ করতে করতে যেতাম ইস্কুলে। তখনও কলকাতা ফ্ল্যাট বা অ্যপার্টমেন্ট কালচারে অভ্যস্ত হয়নি এতটা। বড় বড় বাড়ির এক একটা গাড়ি-বারান্দা হতো মেট্রোরেলের স্টেশন। আর আমি সাজতাম মেট্রোরেল। দৌড়োতে দৌড়োতে ওইসব স্টেশনে ঢুকে জিরিয়ে নিতাম খানিক। পিছিয়ে পড়া বাবা ততক্ষণে আমায় ছুঁয়ে ফেলতেন। মধুমন্তী মৈত্র'র বলা কথাগুলি আউড়ে, ফুটপাথের বামদিকে কাল্পনিক যাত্রী নামিয়ে-উঠিয়ে আবার রওনা দিতাম গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। বাবার সঙ্গে ট্রাম ধরে বাড়ি ফিরব বলে।

একদিন ট্রামের পয়সা ফুরিয়ে গিয়েছিল। আমি জেদ ধরলে গড়িয়াহাট থেকে অনেকটা লিচু কিনে ফেলল বাবা। পকেটে পয়সা শেষ। সেদিন ফার্ন রোডের জগবন্ধু ইন্সটিটিউশন থেকে ক্যাওড়াতলার মোড় হেঁটে ফিরেছিলাম। তখন আমি ক্লাস থ্রি।

আরেকটি ঘটনা ২০০৮ সালের। তখনও আমার বিয়ে হয়নি। বাবা ইস্কিমিক হার্ট প্রবলেম নিয়ে নার্সিং হোমে ভর্তি। বাড়িতে আয়কর দপ্তরের কমিশনারের থেকে চিঠি এল। বাবার পাংকচুয়ালিটি নিয়ে ওয়ার্নিং লেটার। মাকে জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার? মা বললেন, অফিসের কলিগ ফোন করেছিলেন। বললেন কিচ্ছু করার দরকার নেই। কমিশনার কিছুদিনের মধ্যেই বদলি হয়ে যাবেন। আমিও বাবাকে ওই অবস্থায় আর কিচ্ছু জানাইনি। খুব সম্ভব মা-ও। কমিশনার কিছুদিনের মধ্যেই বদলি হলেন। বুঝলাম, গালাগাল শুধু আমিই খাই না, চাকরিতে আমরা বাপ-ছেলে সব্বাই চাকর।

এর চেয়েও মারাত্মক ঘটনা ঘটেছিল ২০১৯ সালে। ততদিনে আমি মুম্বইতে থিতু হয়ে গিয়েছি। সিবিআই থেকে বাবাকে মুম্বইয়ের আয়কর দপ্তরের এক অ্যাডিশনাল কমিশনারের কাছে হাজিরা দিতে বলা হল। এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে যিনি কিছুদিন বাবার দপ্তরে কমিশনার র‍্যাঙ্কে কাজ করেছিলেন। সেই প্রথম আমার আই আর এস অফিসারদের সামনা সামনি টক্কর নেওয়া। বাদী ও বিবাদী পক্ষের উকিল (এঁরাও আয়করেরই লোক, সরকার পক্ষে একটি বাচ্চা ছেলে, আর যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তার হয়ে এক রিটায়ার দুঁদে ব্যক্তি সওয়াল-জবাব করছিলেন) সহ অফিসার বেশ রাশভারী আওয়াজে সব শুরু করলেন। সকাল সাড়ে এগারোটা থেকে শুরু করে প্রায় দু'টো বাজার সময়ও যখন দেখলাম জেরা চলছে এবং বাবা টেম্পারামেন্ট হারিয়ে ফেলছেন, আসামী পক্ষের উকিল ক্রমাগত নাস্তানাবুদ করে চলেছেন বাবাকে একের পর এক প্রশ্নবাণ হেনে, তখন বাধ্য হয়ে আমায় আসরে নামতে হল। এবং ঘন্টাখানেকের মধ্যে নিজের কর্মক্ষেত্রের বহু লিগ্যাল কেসের অভিজ্ঞতা থেকে বাবাকে ঠাণ্ডা মাথায় বার করে নিয়ে এলাম ওই ঘর থেকে। কাজ তো একটাই ছিল। হরে দরে বাবার পক্ষ থেকে বুঝিয়ে দেওয়া যে ভাই, আমার বয়স হয়েছে, হার্টের পেশেন্ট, তায় বহু, বহু বছর আগের ঘটনা(কেসটি ২০০৪ সালের)। তাই কী ঘটেছিল কিস্যু মনে নাই! ওষুধে কাজ হল। আর বাপ ছেলে সাড়ে তিনটের সময় ছুটি পেয়ে ভিলে পার্লের ফুটপাথে একে অপরের দিকে উল্টোমুখ করে সিগারেট টানতে থাকলাম। ছাড়া পাওয়ার সময় শুধু সরকারী অফিসারটি আমায় এক গাল হেসে বলেছিল, আপ থে ইসলিয়ে স্যর কো জলদি ছুটকারা মিল গ্যয়া!

ও নিজেও ছুটি পেয়েছিল আসলে, সেদিনকার মতো।

তবে বাবার থেকে সবচেয়ে বড়ো আঘাত পেয়েছিলাম তিনি চলে যাবার পর। ২০২০-র জুনে বাবা চলে গেল। জয়ীর মা গেলেন ২০২১-এ। আর ২০২২-এ প্রায় চল্লিশবছর বয়সে জয়ী দ্বিতীয়বার কনসিইভ করল। আমি বললাম, বাবা আসছেন। জয়ী বলল, ধ্যুত! আমার মা আসছে।

সেপ্টেম্বরে পাঁচ মাস পুহিয়ে পঞ্চামৃত খেয়ে অ্যানোম্যালি স্ক্যানে সবকিছু ঠিকঠাক। বাড়িতে সাত মাসের সাধের দিনক্ষণ দেখা চলছে। অ্যানোম্যালি স্ক্যানের ঠিক এক সপ্তাহের মাথায় জয়ীর হঠৎ দু'দিনের জ্বর... আর সব শেষ! রাত তিনটের সময় যতক্ষণে জয়ীকে একশো এক জ্বর নিয়ে পার্ক্সট্রিট নেওটিয়াতে ঢোকালাম, ততক্ষণে ভ্যাজাইনাতে ফেটাল পার্টস নেমে এসেছে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...