কালীপ্রসন্ন সিংহ : ক্ষণজীবী এক ক্ষণজন্মা

আমাদের চৈতন্যের বিকাশ ঘটতেই যেখানে জীবনের প্রথম তিরিশটা বছর পেরিয়ে যায়, সেখানে মাত্র তিরিশ বছরের আয়ু নিয়েই সমাজ ও সাহিত্যের বহুধা ক্ষেত্রে সংস্কারকের চিরস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। মনীষী বলতে যা বোঝায়, তিনি ছিলেন তা-ই।

পিতা নন্দলাল সিংহ ছিলেন পুরুষানুক্রমে জোড়াসাঁকোর জমিদার। তাই পুত্রের জন্মের পর বেশ ঘটা করেই এক উৎসবের আয়োজন করেছিলেন। তাতে বাঈনাচের জাঁক তো ছিলই, তা উপভোগ করার জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিলেন শহরের সমস্ত অভিজাত এবং পণ্ডিতের দল। তাঁদের প্রত্যেককে কাশ্মীরি শাল ও নানান উপহার দিয়ে বিদায় জানানো হয়েছিল।

নন্দলাল নিজেও দীর্ঘজীবী ছিলেন না। কলেরায় ভুগে নিতান্ত যৌবনেই তিনি মারা যান। তাঁর মৃত্যুর সময় কালীপ্রসন্নের বয়স ছিল মাত্র ছয়। পিতৃবন্ধু ও প্রতিবেশী হরচন্দ্র ঘোষ তাঁকে মানুষ করার দায়িত্ব নেন। এবং জমিদারী দেখভালের দায়িত্বও নিজের কাঁধে তুলে নেন। রক্ষকই ভক্ষক হয়ে ওঠার চিরকালীন ঐতিহ্যের মাঝে হরচন্দ্র কিন্তু প্রকৃতই ভদ্রলোক ছিলেন। তিনি কালীপ্রসন্নর সম্পত্তির পরিমাণ যেমন বাড়িয়ে তুলেছিলেন, তেমনি তাঁকে লায়েক করে তুলতেও কম কসুর করেননি।

বাল্যে বিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে কালীপ্রসন্ন খুব একটা সুবিধে করতে পারেননি। আসলে, স্কুলে পড়ানোর সেকেলে ধরণধারণ তাঁর খুব একটা ভালো লাগেনি। তাই হিন্দু স্কুলে ভর্তি হয়েও যাওয়া বন্ধ করে দেন। তবে তিনি হাল ছাড়লেও হরচন্দ্র হাল ছাড়েননি।

তিনি করেছিলেন কী, সাহেব-মাস্টার রেখে কালীপ্রসন্নকে বাড়িতেই ইংরেজি পড়ানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। ভালো পণ্ডিত রেখে সংস্কৃত ও বাংলা শেখানোর আয়োজন করেছিলেন। এই শিক্ষকদের আন্তরিক সাহচর্যে বছর চারেকের মধ্যে তিনটে ভাষাতেই কালীপ্রসন্ন বেশ দক্ষতা অর্জন করেছিলেন।

কালীপ্রসন্ন শিক্ষিত হয়েছিলেন, কিন্তু যুগের হাওয়ায় হারিয়ে যাননি। বাংলা ভাষা যখন সাধুভাষায় মাধুর্য বিলিয়ে সকলের লিখন-ভাষা হয়ে উঠেছিল; তখন তিনি সকলকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন মুখের ভাষা দিয়েও কেমন অসাধারণ ছবি আঁকা যায়, মাধুরী বিলানো যায়।

 

Kaliprasanna-Singha1

 

এই সময় হুতোম প্যাঁচা ছদ্মনামে 'হুতোম প্যাঁচার নকশা' নামে যে অপূর্ব সমাজচিত্রটি তিনি লিখেছিলেন, তা তাঁর কুড়ি-একুশ বছর বয়সের রচনা। এই বয়সে এমন পরিণত রচনা প্রতিভা না-থাকলে হয় না। প্রতিভা না-থাকলে অমন নির্মোহ হয়ে চলিত ভাষার আশ্রয় নিতে তিনি পারতেন না। আসলে, মানুষটা যুগের চেয়ে তিনি কয়েক কদম এগিয়েই চলতে শিখেছিলেন।

বাংলায় শ্রুতিনাটক পরিবেশনের প্রবর্তনও ঘটেছিল তাঁরই হাত দিয়ে। 'সংবাদ প্রভাকর' পত্রিকায় ৪ জুন ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত এক সংবাদ থেকে আমরা উক্ত তথ্যটি জানতে পারি, যথা:

"আগামি শনিবার ৭ ঘন্টার সময় কলিকাতা বিদ্যোৎসাহিনী সভার রঙ্গভূমিতে শ্রীযুত বাবু কালীপ্রসন্ন সিংহ প্রণীত সাবিত্রী সত্যবান নাটকের আভিনয়িক পাঠ হইবেক এরূপ প্রথা বঙ্গবাসিগণের মধ্যে প্রচলিত নাই, তবে ইংরাজী সেকসপিয়র প্রভৃতি নাটক যেরূপ পঠিত হইয়া থাকে ইহাও সেইরূপে পঠিত হইবেক অধিকন্তু ইহাতে বিস্তর গীত সংযোজিত হইবায় তাহা যন্ত্রের সহিত মিলাইয়া গান করা যাইবেক।"

কালীপ্রসন্নর মহান কীর্তি 'বিদ্যোৎসাহিনী সভা' স্থাপন। বাংলা ভাষাচর্চা, সাহিত্যচর্চা ও সমাজ সংস্কারে তাঁর নেতৃত্বে এই সভা অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল। মধুসূদন অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রবর্তন করলে সর্বপ্রথম তাঁকে সভার পক্ষ থেকে সংবর্ধনা ও সম্মান জানানোর ব্যবস্থা করেছিলেন কালীপ্রসন্ন। শুধু তাই নয়, 'বিবিধার্থ সংগ্রহ' পত্রিকায় ঘোষণা করেছিলেন যে, এই কীর্তির জন্য মধুসূদন বাংলা সাহিত্যে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। মধুসূদনের পর তিনিই প্রথম বাঙালি, যিনি অমিত্রাক্ষর ছন্দে কবিতা লিখেছিলেন। সেই কবিতা 'হুতোম প্যাঁচার নকশা'র ভূমিকায় সন্নিবেশ ঘটিয়েছিলেন।

'নীল দর্পণ' ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করে লং-সাহেব যখন আদালতে শাস্তি পেলেন, তখন স্বয়ং জরিমানার টাকা দিয়ে কালীপ্রসন্ন শুধু লং-কেই রক্ষা করেননি, সমস্ত বাঙালির গর্বের কারণ হয়ে উঠেছিলেন।

ছাত্রদের মধ্যে বাংলা ভাষাচর্চায় উৎসাহ দেওয়ার জন্য রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে পুরস্কার ও সম্মান প্রদর্শনের এক অনন্য নজির সৃষ্টি করেছিলেন কালীপ্রসন্ন। বাংলা সাহিত্যজগতে তাঁর আর একটি উল্লেখযোগ্য কাজ, সংস্কৃত থেকে মহাভারতের সম্পূর্ণ অনুবাদ ও প্রকাশ। তাঁর এই কাজ আজ দেড়শ বছর পরেও সমান আদৃত। শুধু নিজের লেখা বই নয়, অন্যের লেখা বই প্রকাশেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন।

সমাজ সংস্কারে তিনি অনুসরণ করেছিলেন রামমোহন-বিদ্যাসাগরের পদাঙ্ক। বিধবা বিবাহের জন্য স্বাক্ষর সংগ্রহ এবং বিধবা বিবাহকারীদের জন্য হাজার মুদ্রা উপঢৌকন তাঁর আরেক কীর্তি। এছাড়া কৌলীন্যপ্রথা রদ প্রভৃতি বিষয়েও তিনি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। বিভিন্ন স্কুল চালানোর জন্য মাসিক অনুদান তো ছিলই।

আসলে, উনিশ শতকের ইতিহাস যাঁদের নিয়ে বাঙালিকে গর্ব করতে প্রাণিত করে, কালীপ্রসন্ন তাঁদের অন্যতম তো বটেই। তিনি ক্ষীণজীবী, কিন্তু ক্ষণজন্মা পুরুষ-ইতিহাস পেরিয়ে আজকের আয়নাতেও...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...